গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দু`য়সার পালা: `মধুর` মহুয়া-কাব্য
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪০তম স্থানে!
সৌমিত্র সেন
মহুয়া মৈত্র একটি পুরনো লড়াই মনে করিয়ে দিলেন। মানবসভ্যতার খুব পুরনো লড়াই। ভাবনার ও কর্মের স্বাধীনতাহরণ এবং তার সঙ্গে স্বাধীনচেতা মনের দ্বৈরথ। যা এখনও বহুরূপে সম্মুখে আপনার-আমার অবিরত চেনা 'মুখে'(ছকে) চলছে!
এখানে স্বাধীনতার প্রশ্নটা অবশ্য সংবাদমাধ্যমের প্রসঙ্গে উঠছে। সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতু্র্থ স্তম্ভ মনে করা হয়। তার মর্যাদা অপরিসীম। কিন্তু কৃষ্ণনগরের সাংসদ ও নদিয়া জেলা তৃণমূলের সভানেত্রী মহুয়া সম্প্রতি নদিয়ার চাকদা ও গয়েশপুরে সংবাদমাধ্যমের রুক্ষ সমালোচনা করে গণতন্ত্রের চতুর্থতম স্তম্ভটির মর্যাদা লঙ্ঘন করলেন।
এত দূর যে, খোদ কলকাতার প্রেস ক্লাবকে আজ, সোমবার একটি বিবৃতি দিতে হল! বিবৃতিটি হুবহু এই: 'কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র সাংবাদিকদের সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন তাতে প্রেস ক্লাব, কলকাতা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তীব্র প্রতিবাদ করছে। তাঁর এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত, অপমানজনক।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবাদিকতার গুরুত্ব এবং এই পেশার সম্মান সর্বজনবিদিত। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন সাংবাদিকের পেশাগত সংগ্রাম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি রয়েছে।
সেই মহান কাজের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকদের আঘাত করার কোন অধিকার কারও নেই। ধিক্কার জানাই সাংসদের মন্তব্যে।
আশা করি, সাংসদ তাঁর এই মন্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করবেন।'
কী সেই মন্তব্য যার জেরে জল এতদূর গড়াল?
একটু দীর্ঘ ভূমিকা প্রয়োজন। দু'টি ঘটনা। একটি কয়েকদিন আগের। অন্যটি গতকাল, রবিবারের। চাকদার ঘটনার একটি ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, কর্মিসভার মঞ্চ থেকে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি মহুয়ার বার্তা, 'আপনারা মোবাইল সরিয়ে রাখবেন। এটা ভিডিয়ো রেকর্ডিং বা ছবি তোলার ব্যাপার নয়।' তখনই সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিনিধিকে ভিডিও রেকর্ড করতে দেখা গেলে তাঁকে মহুয়ার সটান প্রশ্ন, 'এখানে প্রেসের ঢোকার কোনও অনুমতিই নেই। আপনাকে এখানে ঢুকতে কে দিল?'
আর দ্বিতীয়টি হরিণঘাটার। রবিবার গয়েশপুরে করিমপুর ২ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মিসভা ছিল। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে 'দু'পয়সার প্রেস' বলে আক্রমণ করে বসেন সাংসদ মহুয়া। নদিয়া জেলা তৃণমূলের সভানেত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রতি মাসে জেলার বিভিন্ন বুথের কর্মীদের নিয়ে সম্মেলন করেন তিনি। এদিনও এমনই এক সম্মেলনে দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন মহুয়া। এখানকারও একটি ভিডিয়ো দেখা গিয়েছে। সেখানে মহুয়াকে বলতে শোনা যাচ্ছে, 'কে এই দু'পয়সার প্রেসকে ভেতরে ডাকে? সরাও প্রেসকে এখান থেকে। কেন দলের মিটিংয়ে প্রেস ডাকো তোমরা? কর্মী বৈঠক হচ্ছে আর সবাই টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত। আমি দলের সভানেত্রী, আমি আপনাদের নির্দেশ দিচ্ছি, প্রেসকে সরান।' পরে এ ব্যাপারে মহুয়ার প্রতিক্রিয়া, 'ছেড়ে দাও ভাই।'
কেন হঠাৎ সংবাদমাধ্যমের প্রতি এত বিবমিষা শাসকদলের এক জনপ্রতিনিধির? কেন তিনি আদৌ সহ্য করতে পারছেন না প্রেসের অস্তিত্বকে? কেন তিনি 'ছেড়ে দাও' বলে সযত্নে এড়িয়ে যান এত গুরুতর এক বিষয়কে?
এ আসলে নতুন কোনও ব্যবহার নয়। শাসকের মুখ এমনই হয়। যখন মুখ ও মুখোশ এক হয়ে যায় আর কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন সেই প্রশ্নময় মুখ বন্ধ করে দিতে এটাই দস্তুর। এই তো কিছু দিন আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ-জাতীয় স্বেচ্ছাচারিতা দু'চোখ ভরে দেখেছে বিশ্ব। সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর নিয়মিত কটূবাক্য, হুমকি, হুঁশিয়ারি ও ধমক দেখে থমকে গিয়েছে বিশ্ব! মহুয়া, অতএব, নতুন কিছু করেননি!
মাত্র কিছুদিন আগের একটি রিপোর্টও একই কথা বলছে। ২০১৯-এর এপ্রিলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা 'রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডাসে'র একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই তালিকায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪০তম স্থানে! এ হেন রেটিংয়ের দিকে 'চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই'!
অতএব, মহুয়া নতুন কিছুই করেননি। ওই দৈন্যটিকেই ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন। অথচ সেই কতদিন আগে মানুষ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ভেবেছে। ১৭৬৬ সালে সুইডেন বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে 'ফ্রিডম অফ প্রেস অ্যাক্টে'র মাধ্যমে প্রেসের স্বাধীনতাকে সংবিধানে ঠাঁই দিয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল: প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা এবং কোনও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য ও ধারণা অনুসন্ধান এবং গ্রহণের স্বাধীনতাও স্বীকার করা জরুরি!
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা! তোমার নিবেদন নাই প্রেস!
also read: ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ শিকার হবেন চরম দারিদ্র্যের: রাষ্ট্রপুঞ্জ