কুশল মিশ্র


নীল ঘুড়িটা লাল ঘুড়িটাকে একটা চুক্কি মেরে ঢুকে গেল নীল আকাশের পেটে। তারপর বোঁ বোঁ করে পান্তে ঘুড়ির সে কী চরকিপাক। একতে, দোতে সব হাওয়া। বাজার হিট পান্তের।এর জন্য ব্যাটারিও কম পোড়াতে হয়নি। রাত জেগে টিকলি ধরে বসে থাকতে হয়েছে। সুতোয় ঝিলিক মেরেছে কাঁচের গুড়ো। মাঞ্জাও হয়েছে বেড়ে। কাঁচের সঙ্গে অ্যারারুটের মিক্সিং। বুদ্ধুর বাড়িতে রান্নার পর নিবু আঁচে অ্যারারুট গোলা হয়েছে। বিশ্বকর্মা পুজো মানেই ন্যাবার কাছে একটা ব্যাপার। অনেকটা স্বাধীনতা দিবসের মতো। আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি ভেসে বেড়াতে ভারি ভালো লাগে ন্যাবার। মনে হয় পৃথিবী ছাড়িয়ে দূরে অনেক দূরে কোনও উপগ্রহে গিয়ে যদি বসে থাকা যেত সব থেকে ভালো হত। ন্যাবার মনে অনেক কিছু খেলা করে। মনে হয় ঘুড়িতে চেপে যদি মেঘের দেশে পৌছনো যেত তবে বেশ ভালো হত। তারজন্যে অবশ্য পেল্লাই একটা ঘুড়ি বানাতে হবে। কাছা দড়িতে উড়বে পাহাড়প্রমাণ সেই ঘুড়ি। তারমধ্যে ন্যাবা বসে থাকবে। ঘুড়ি আস্তে আস্তে বাবুটি, গৌতম, চিল্কু, অরনীদের, পিঙ্কু, সলিল জ্যাঠা, সাহাদের বিশাল ইমারতি বাড়িকে ভেঙচি কেটে উড়ে যাবে আকাশে। সব বাড়ি, সব গাছ ছাড়িয়ে সবার ওপরে টেক্কা দেবে শুধুই ন্যাবা। আকাশের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে ন্যাবাদের ঝিমধরা গলিটাকে মনে হবে একটা সুতলি দড়ি। পয়সাওয়ালা বাবুদের ঝিনচ্যাক ফ্ল্যাটগুলোকে দেখলে মনে হবে দেশলাইয়ের বাক্স। পাড়ার মোড়েই রিঙ্কিদের বাড়ি। রিঙ্কি। ন্যাবাদের বাড়ি থেকে একটু এগোলেই তালতলা মাঠ। মাঠের গায়েই তিনতলা রিঙ্কিদের বাড়ি। একতলার গ্রিলে সবসময় জিভ বের করে হাঁফায় একটা বড় কুকুর। রিঙ্কি বলেছিল ওটার নাম আলসেশন। বিদেশি কুকুর। রোজ ওর জন্য মাংসের স্টু হয়। চানের জন্য আসে দামি সাবান। ডাক্তারও আছে আলাদা। বেশ বড়লোক ব্যাপার। ন্যাবাদের বাড়িতেও মাংস হয়। ন্যাবার বাবা রবিবার আনে। তাতে মুরগির হাড়, চর্বি, নাড়িভুঁড়ি সবই থাকে। বুদ্ধু বলেছিল ওগুলোকে মাংসের ছাঁট বলে। মাংসের থেকে অনেকটাই সস্তা। ওটারই যা টেস্ট তাতেই তিন থালা ভাত সাবাড় করে দেয় ন্যাবা। ন্যাবার বোন জুলজুল করে চেয়ে থাকে ন্যাবার দিকে। ওর বয়সটা খুবই ছোট। মুখে চুষিকাঠি আর ঝুনঝুনি। গোল গোল চোখে সারা পৃথিবীর ছায়া পড়ে খুকির মুখে। ন্যাবার রিঙ্কিকে খুব ভালো লাগে। একদম মাখন। কী সুন্দর সুঢৌল হাত। চোখগুলো যেন পুরো ফিল্মি। করিনা কাপুরের মতো। বিশাল ঘাগরা পরে বেনি দুলিয়ে রিঙ্কি যখন বিকেল বেলায় পড়তে যায় মনে হয় করিনাই যেন হেঁটে যাচ্ছে। বুদ্ধু-বাপি, চিঙ্কা, ভ্যাবলা, সবাই ছক করে মনে মনে। লাভকি দুনিয়ার সুপারহিট মুকাবিলায় ন্যাবার মনে হয় ওদের থেকে সে যেন একটু এগিয়েই আছে। আগেরবার বিশ্বকর্মা পুজোয় একটা ঘুড়ি লটকে রিঙ্কিদের ছাদেই পড়েছিল। পাঁচিল টপকে দেওয়াল বেয়ে তরতরিয়ে রিঙ্কিদের বাড়ির ছাদে উঠে গিয়েছিল ন্যাবা। ঘুড়িটা নিয়ে যখন দেওয়াল বেয়ে নিচে নামছে তখনই বারান্দায় রিঙ্কির চোখে পড়েগিয়েছিল ন্যাবা। হায়রে যেন বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল কে। আধঝোলা অবস্থাতেই রিঙ্কির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল ন্যাবা। হঠাতই খিল্লি হাসি। চটকা ভাঙতেই রিঙ্কির দিওয়ানি হাসিতে দিলদিবানা ন্যাবার। তাকাতেই একছুট্টে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল রিঙ্কি। তারপর থেকেই রিঙ্কিকে দেখলে ন্যাবার বাঁ বুকটা কেমন চিনচিন করে। বড় ব্যথা। পুজো আসলে হার্টের প্রবলেমটা আরও বাড়ে। ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। পুজোর সময়টা প্যান্ডেলের আলোয় আরও ফিল্মি লাগে রিঙ্কিকে। গতবারের সপ্তমীর রাতে বড় ব্যথা পেয়েছিল ন্যাবা। প্যান্ডেলের পেছনে ইয়ে করতে গিয়ে রিঙ্কি আর গৌতমকে ইয়ে অবস্থায় দেখে। তারপর অবশ্য ন্যাবা নিজেকে বুঝিয়েছে রিঙ্কিদের সঙ্গে তাদের মেলেনা। ওদের বাড়ি তিনতলা। ন্যাবার ঝুপড়ি ঘর। তারপর থেকেই ন্যাবার ধ্যানজ্ঞান ঘুড়ি। এই একটা জায়গায় সব শালাই সমান। আকাশ কারোর বাবার সম্পত্তি নয়। সবাই উড়তে পারে এখানে। আর ঘুড়িরও কোনও নিয়ন্ত্রণরেখা নেই। যে যেমন পারো ওড়ো। এই ওড়ার আনন্দেই ন্যাবা মন দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেয়। সারা বছরের পয়সা জমিয়ে সুতো কেনে। যতক্ষণ না একটা বিন্দুর মতো হচ্ছে ঘুড়ি ততক্ষণ ন্যাবা সুতো ছেড়ে যায়। ছেড়েই যায়। একটা আকাশ হওয়ার স্বপ্নে।