সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

শীতে শরতের অবসান! তা-ই তো হয়! প্রফুল্ল শরৎ শেষ হয়ে হলুদ হেমন্ত আসে আর হেমন্তের সেই ধূসর পথরেখা ধরেই আসে মলিন শীত। নির্মম কঠিন সেই শীতের গর্ভেই তো মৃত্যু হয় প্রফুল্ল শরতের; নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সে।


প্রকৃতিতে যা, জীবনেও কি তাই? বোধ হয়! কেননা, এই শীতের ভিতরেই তো বাঙালি হারাল তার শরৎ-কবিকে। নির্মম সেই শীতের গর্ভেই মৃত্যু হল বটে প্রফুল্ল শরতের; তবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার গল্প এ নয়। কেননা, কবির তো মৃত্যু নেই। কবির মৃত্যু হয় না। বরং মৃত্যুর পরই কবি নতুন করে বেঁচে ওঠেন। হয়তো তেমন করেই বেঁচে উঠবেন শরৎও। আর বাঙালিরও কখনও শেষ হবে না  শরৎকবিতার পাঠ, পুনঃপাঠ।


সোমবার রাতে, সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রয়াত হন নবতিপর কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতার মধ্যে দিয়েই দিন কাটছিল কৃত্তিবাস-গোষ্ঠীর অন্যতম এই কবির। তাঁর পরিকরসূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়। তাঁর পরিবার-পরিজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করেন। তবে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর।


১৯৩১ সালে কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। প্রথমজীবনে 'নমিতা মুখোপাধ্যায়' ছদ্মনামে লিখতেন বলে জানা গিয়েছে। লিখেছেন 'ত্রিশঙ্কু' ছদ্মনামেও। পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। তাঁর চর্চিত কবিতাবই 'সোনার পিত্তলমূর্তি', 'অন্ধকার লেবুবন', 'আহত ভ্রুবিলাস'। প্রায় তেরোটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর। এ ছাড়াও অজস্র রচনা আছে। পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু ছন্দ ও ছন্দহীনতা উভয় শৈলীতেই উত্তাল তাঁর মতো এক কবির কি পুরস্কারে সার্থক মূল্যায়ন হয়?


মূল্যায়ন হয় পাঠকের দরবারে। এ শহরের নিগূঢ় কবিতাচর্চাকারীদের গোপন মত হল-- যে ধরনের কাব্যভাষার জন্য কৃত্তিবাস গোষ্ঠী বিখ্যাত, বা ঠিক যে-ধাঁচের কাব্যিক প্রকাশভঙ্গির জন্য স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশিষ্ট, তা নাকি প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাভাষায় শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়েরই দান। আসলে তিনি নিজের পেশায় নিয়োজিত থাকতেন বেশি, সর্বসময়ের লেখক হননি, হয়তো হতে চাননিও; তাই হয়তো এই ধরনের দাবিগুলি নিয়ে সেভাবে কখনও প্রকাশ্যে আসা সম্ভব হয়নি তাঁর বা তাঁর একান্ত বৃত্তের পক্ষে। একটু সরে থাকা, একটু আড়ালে থাকা, একটু প্রচারবিমুখতাই যেন দস্তুর হয়ে গিয়েছিল তাঁর পক্ষে। কিন্তু তাঁর অবদান তাতে ছোট হয়ে যায় না।


অত্যন্ত নাগরিক, ঝকঝকে স্মার্ট, নির্মেদ, গতিময় এক কব্যভাষার জন্ম শরৎকুমার সেই সময়েই দিয়েছিলেন যা পঞ্চাশোত্তর নতুন যুগের বাংলা কবিতাকে নীরবে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল। এবং ঘন মধুর মতো যা টপ টপ করে চুঁইয়ে পড়ে আজও হয়তো ভিতরে ভিতরে ঋদ্ধ করে চলেছে বাংলা কবিতাকে। শরৎ হয়তো শক্তির মতো 'হ্যালো' নিয়ে ঘুরতেন না, সুনীলের মতো জনপ্রিয়তার বলয়ও তাঁকে ঘিরে সদা বিবর্তিত হত না, হয়তো শঙ্খ ঘোষের মতো আভিজাত্যও তাঁর নামের সঙ্গে অন্বিত হয়নি কিংবা বিনয় মজুমদার-সুলভ প্রজ্ঞা ও উন্মাদনার মিশেলও তাঁকে সুদূরের নক্ষত্র করে তোলেনি। কিন্তু তিনি তাঁর শারদীয় কাব্যশব্দে এ মহানগরের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তকে বারে বারে নিবিড় ভাবে ছুঁয়ে গিয়েছেন।


বাংলা কবিতার পাঠক কি কোনও ভাবে ভুলতে পারে তাঁর 'আহত ভ্রূবিলাস'-এর 'খুকী সিরিজ'? সেই 'খুকী তোমার নাম কী? চৈতালী।/ আমার নাম শরৎ— মনে ধরে?/ তুমি ছুটছ দিচ্ছ করতালি/ পাল্লা দেবো? কোমর ব্যথা করে!' পঞ্চাশের কবিদের জীবনযাপন ও  কবিতাযাপন সবটাই পরবর্তী কালে মিথ হয়ে গিয়েছে। সেই মিথেরই চিহ্ন ছড়িয়ে শরৎ-কাব্যেও— 'রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক/ চৌরঙ্গী ভবানীপুর থেকে শ্যামবাজার বদ্বীপ'। এই চরণও তো পরবর্তী সময়ে কিংবদন্তি। আসলে তাঁর কাব্যনামের মতোই তিনিও চিরকালই ছিলেন সংযত, ছিলেন প্রস্তুত। তাঁর কাব্য-বদ্বীপ থেকে তাই কেবলই বিচ্ছুরিত হয়েছে সংযম ও প্রস্তুতির নিভৃত উচ্চারণ। 


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)