বিভূতিভূষণের 'চাঁদের পাহাড়' তাঁকে টেনেছিল। শঙ্করের মতই একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। খোঁজের গন্তব্যে পথে নেমেছিলেন সে দিন। দিন যত গড়িয়েছে খোঁজের নেশা আরও মাথায় চেপেছে। পাহাড়ে চূড়া থেকে বরফে ঢাকা এস্কিমোদের দেশ- পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবিরাম ছুটে চলেছেন। শুধুই অজানাকে জানার নেশায়। কখনও তাঁকে 'গুপ্তচর' ভেবে ভুল করেছে প্রতিবেশী দেশ। কখনও আবার পাহাড়ের খাদে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। যেন মৃত্যুর দোরগোড়ায় যাওয়া-আসাটাই তাঁর অভ্যেস। তিনি 'অভিযাত্রী' অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে অভিযানই জীবন, জীবিকা এবং প্যাশন। সম্প্রতি সাইকেলে পার করেছেন ধূ ধূ সাহারা প্রান্তর। । তাঁর শিহরণ জাগানো অ্যাডভেঞ্চারের ঝুলিভর্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন ২৪ ঘণ্টা ডট কমের প্রতিনিধি সুদেষ্ণা পালের সঙ্গে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আপনি তো একজন পর্বতারোহী?


অনিন্দ্য- না। আমি নিজেকে শুধুমাত্র পর্বতারোহী বলে মনে করি না। আমি একজন 'অ্যাডভেঞ্চারার'। বাংলায় জন্ম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পর্বতারোহণের একটা সুযোগ থাকে। পর্বতারোহণের পিছনে জ্যাঠামশাইয়েরও একটা প্রভাব ছিল। খুব ছোট থেকেই রক-ক্লাইম্বিং করেছি। কিন্তু কোনও জিনিস একটানা বার বার করার পর তো একটা একঘেয়েমি আসে, আমার ক্ষেত্রেও শুধু পর্বতারোহণ করতে করতে একটা সময় একঘেয়েমি এসেছিল। সেই একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্যই বেড়িয়ে পড়েছি। শঙ্করের পায়ের চিহ্ন ধরে খোঁজ করেছি চাঁদের পাহাড়ের...


শঙ্কর অনুপ্রেরণা?


অনিন্দ্য- শঙ্কর চাঁদের পাহাড়ের খোঁজে বেড়িয়েছিল... তারপর সে রিখটার্সভেল্ডে গিয়ে শেষ করে। তখন কৌতূহল হয়, সত্যিই কি চাঁদের পাহাড় বলে কিছু আছে? সেগুলো নিয়ে রিসার্চ করতে করতেই মধ্য আফ্রিকায় উগান্ডা ও কঙ্গোর সীমান্তে 'মাউন্টেন অফ দ্য মুন'-এর সম্বন্ধে জানতে পারি। সেখানে একটা ব্যাকপ্যাকিং ট্রিপ করি। ১৯৩৭ সালে এই 'মাউন্টেন অফ দ্য মুন'-এর সম্বন্ধে পড়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও, সেখান থেকেই 'চাঁদের পাহাড়'-এর সৃষ্টি। 


ভিন্নতার খোঁজে এরপর ২০১২ সালে বিষুবরেখা থেকে মকরক্রান্তি রেখা পর্যন্ত  একটা সাইকেল ট্রিপ করি। কেনিয়া থেকে নামিবিয়া, মোট ৫টি দেশ ৫ হাজার কিলোমিটারের  জার্নি ছিল সেটা। আমার এই প্যাশনের পিছনে রয়েছে মূলত বিভিন্ন গল্প।


পর্বতারোহণ বিশ্বের একমাত্র খেলা, যাকে নিয়ে পাতার পর পাতা সাহিত্য লেখা হয়েছে। লাইব্রেরি গড়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক স্তরে বহু সাহিত্য লেখা হয়েছে শুধু এই পর্বতারোহণ নিয়ে। সেইসব লেখাই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে অভিযানে। বিভিন্ন অভিযাত্রীদের বিবরণ পড়ে তার থেকে অজানা জায়গার রসদ সংগ্রহ করেছি।



আপনার প্রথম অভিযান কবে?


অনিন্দ্য- প্রথম অভিযান ১৯৯৭  সালে। ২৭ বছর বয়সে।


অভিযানের নেশার পিছনে...?


অনিন্দ্য- নেশা শব্দটায় আমার একটু আপত্তি আছে। নেশার মধ্যে কিছুটা নেগেটিভিটি লুকিয়ে থাকে। বলা ভালো প্যাশন। একটা লোক কিছু না করে থাকতে পারবে না। তাকে অ্যাডভেঞ্চার করতেই হবে। সে বাড়িতে থাকতে পারে না। চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমার কৌতূহল মূলত মানুষ। বিচিত্র মানুষ। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যে প্রাপ্তিগুলো ঘটে, সেগুলো পরম প্রাপ্তি। অপরিচিত একজন যাকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। এরকম ঘটনা বারবার ঘটেছে। বিশেষ করে বলতে হয় আফ্রিকার কথা...আফ্রিকার জন্তু-জানোয়ার নয়, আমার কাছে আফ্রিকার মূল আকর্ষণ সেখানকার মানুষই। অ্যাডভেঞ্চার ইজ এ ওয়ে অফ লাইফ...অ্যাডভেঞ্জার মানে শুধুমাত্র থ্রিল নয়। অ্যাডভেঞ্চার একটা দর্শন।



তবে আমাদের সমাজে এখনও অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা শুধু সাহিত্যেই। সেই শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীতে শঙ্কর...এখনও আমাদের সমাজে কেউ একজন প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারার হবে, অভিযাত্রী হবে সেটা অনেকটা ইউটোপিয়ার মত। বাঙালি বলে বটে অ্যাডভেঞ্চার, কিন্তু আমাদের সমাজের অ্যাডভেঞ্চার কই?


বর্তমানে বেশ কয়েকটি সিনেমা হয়েছে অ্যাডেভঞ্চার গল্পগুলো নিয়ে...


অনিন্দ্য- চাঁদের পাহাড় গল্পের কোনও তুলনা নেই। বিশ্ববন্দিত সাহিত্য। কিন্তু সেই গল্পটাই যখন সিনেমা হল তখন আজগুবি এমন জিনিস দেখানো হল, যেগুলো হাস্যকর। বিন্দুমাত্র রিসার্চ নেই। কিন্তু মানুষ সেগুলোই দেখছে। ব্লকবাস্টারও হচ্ছে। এবার ইয়েতিদের নিয়েও সিনেমা আসছে।


ইয়েতি আছে, আপনি বিশ্বাস করেন?


অনিন্দ্য- দীর্ঘ ৬ থেকে ৭ বছর ধরে হিমালয়ে নতুন প্রাণীর খোঁজ নিয়ে আমার অভিযান চলছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের থেকেও বিষয়টা বিজ্ঞানভিত্তিক। সিকিমে লোকমুখে প্রচারিত বনমানছির গল্প। ওখানকার লোক বলে, ইয়াকের লোম পকেটে রাখলে বনমানছি ধরবে না। বনমানছি নাকি ৪ ফিট লম্বা। হঠাত্ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়। ওখানকার মানুষ বলে, অশরীরী আত্মা। উত্তর সিকিমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযানের সময় আমিও এক অজানা প্রাণীর পায়ের ছাপ পেয়েছি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের তালিকায় যার উল্লেখ নেই।  এই অজানা পায়ের ছাপ নতুন কোনও প্রজাতি আবিষ্কারের পথ নির্দেশক হতে পারে।



অভিযানে আতিথেয়তা...


অনিন্দ্য- বিভিন্ন জায়গায় অভিযানের সুবাদে দেখেছি সাধারণ মানুষে কোনও বিভেদ নেই। সাধারণ মানুষ সব জায়গাতেই ভাল। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে ধর্ম, রাজনীতি। আমি যত অভিযান করেছি, কোথাও কেউ ভাবেনি আমার ধর্ম কী? আমার ধর্ম আমি একজন মানুষ, একজন অভিযাত্রী। মন ছুঁয়ে যাওয়া আতিথেয়তা পেয়েছি। জল চাইলে জল পেয়েছি। রাতে থাকতে চাইলে আশ্রয় পেয়েছি।


সাহারায় সাইকেল নিয়ে অভিযানের সময় এক সাহারউই পরিবার চা খাইয়েছিল। বড় বড় চিনির ডেলা দিয়ে তৈরি খুব মিষ্টি সেই চা। একঘণ্টা লাগে তৈরি করতে। সাহারউই সাহারার আদি উপজাতি। যাযাবর গোষ্ঠী। চা খাওয়ানোটা ওদের কাছে অতিথিকে সম্মান জানানো। এটাই ওদের রীতি।



মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা...


অনিন্দ্য- বিপদ ছাড়া অভিযান হয় না। বিপদ অভিযানেরই একটা অংশ। অভিযান করতে গিয়ে বহু অভিযাত্রীর মৃত্যু ঘটেছে। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এটাকে নিয়ে মিডিয়া অনেকসময় অতিরিক্ত বেশি কাটাছেঁড়া করে, অনেক বড় করে দেখায়। তবে হ্যাঁ, একবার একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চিনে ইয়াং-সি-কিয়াং নদীর দ্বিতীয় বেন্ডে আমি তখন একটা পর্বতমালার খোঁজে ছিলাম। সেইসময় স্থানীয় প্রশাসন আমাকে গুপ্তচর ভাবে। একটা পাহাড়ের মাথায় হাতাহাতির মত পরিস্থিতিও তৈরি হয়।


কিন্তু এই ইউনান চিনে অভিযানের সময় আমি একটা পর্বতমালার আবিষ্কার করি। ওই গ্রামের নামেই পর্বতমালাটির নাম দিই চিতেকেশান। আমেরিকান আলপাইন জার্নালে এই পর্বতমালার কথা ছাপা হয়। মাত্র ৭০০ ডলার পকেটে নিয়ে একা অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলাম। একটা পর্বতমালা আবিষ্কার করে ফিরলাম। নিজেরই ভাবলে মাঝে মাঝে অবাক লাগে।


হিমালয়ে ওঠা কি এখন ভীষণ সহজ?


অনিন্দ্য- মাউন্ট এভারেস্ট সহ হিমালয়ের আরও বেশকিছু ৮০০০ মিটার উচ্চতার শৃঙ্গে ওঠার বিষয়টা এখন অনেকটা ট্যুরিজম প্যাকেজের মত হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছর বহু লোক হিমালয়ে উঠছে। কিন্তু এগুলো সবই অ্যাডভেঞ্চার নয়। ঠিক যেমন আমি মহাকাশে ঘুরে এলেই মহাকাশচারী হয়ে যাব না। সব ব্যবস্থা ওখানে করাই থাকে। তাঁবু খাটানো, রান্না করে দিচ্ছে একজন। এমনকী পায়ের জুতোর ফিতেটাও খুলে গেলে কেউ বেঁধে দিচ্ছে! নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতায় একটা কোনও শিখর আরোহণ প্যাকেজ ট্যুরে গিয়ে এভারেস্ট আরোহণের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। পাশাপাশি, এত বিশাল সংখ্যক লোক যাওয়ায় আখেরে এভারেস্টরই ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু আর্থিক কারণে নেপাল সরকার কখনও তা বন্ধও করবে না। শুধুমাত্র এই এভারেস্ট ট্যুরিজমের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করছে নেপাল সরকার।


গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব?


অনিন্দ্য- ভয়ঙ্কর! হিমালয়ে যেমন লক্ষ করেছি, তেমন আফ্রিকাতেও এর প্রভাব ভয়ঙ্কর। ২০১৫ সালে আফ্রিকার রুয়েনজোরি পর্বতে অভিযান করি। পর্বতের মাথায় সবচেয়ে বড় হিমবাহটার আয়তন দেড় বর্গ কিলোমিটার। আগামী ১০ বছর পর সেই হিমবাহটি আর থাকবে না। কিলিমাঞ্জারোর ক্ষেত্রেও পরিস্থিতিটা একই। হিমালয় হিমবাহগুলোরও আরও খারাপ অবস্থা। গোমুখ অর্থাৎ গঙ্গোত্রী হিমবাহের স্নাউট সম্প্রতি ভেঙেচুরে প্রায় সমতল হয়ে গিয়েছে।


অভিযানের প্রয়োজনীয় অর্থ...


অনিন্দ্য- আর্থিক সমস্যা প্রচুর। মূলত পুরোটাই ব্যক্তিগত খরচে। রাজ্য সরকার একটা তহবিল গড়েছে। অ্যাডভাইসরি বডি রয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই টাকাগুলোর কোনও জাস্টিফিকেশন নেই। টাকা খরচ হচ্ছে কিন্তু বাস্তবিক অভিজ্ঞতার অভাবে সেই টাকা কোনও কাজে আসছে না। অভিযান করে এসে অনেক সময় পরে আফশোসও হয়। এতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল, কিন্তু তবু ঘরে বসে থাকতে পারি না... বেরিয়ে পড়ি...



কেরিয়ার হিসেবে অভিযান...


অনিন্দ্য- এদেশে এখনও অভিযানকে পেশা হিসেবে ভাবার মত মানসিকতাই গড়ে ওঠেনি। তাই অভিযানকে কেরিয়ার করার মত কোনও পরিকাঠামো নেই। এই সমাজ থেকে অ্যাডভেঞ্চারার হওয়া অনেকটা ইউটোপিয়ার মত। অনেক ইনস্টিটিউট আছে বটে, সেখানে পর্বতারোহণ শেখানো হয়। কিন্তু তারপর...? অভিযাত্রী হওয়াটা একটা জার্নি। একটা কোর্স পাশ করে অভিযাত্রী হওয়া যায় না। দুটো অভিযান করলেই অভিযাত্রী হওয়া যায় না। ইদানিংকালে অনেকে 'প্যাকেজ অভিযান' করছে বটে, কিন্তু তা করে কিছু নাম কেনা যায় বা সংবর্ধনা পাওয়া যায় মাত্র। কিন্তু এভাবে ঠিক অভিযান হয় না। অভিযান মানে আমি নিজে কতটা অজানাকে আবিষ্কার করলাম। সেই অভিজ্ঞতাটাই আসল পাওয়া। 


পরিবারকে কতটা পাশে পেয়েছেন?


অনিন্দ্য- আমার বাবা, মা চেয়েছিল আমি ডাক্তারি পড়ি। তাঁদের চাওয়াটাকে আমি অসম্মান করি না। প্রত্যেকেই চায় একটা সামাজিক, আর্থিক নিশ্চয়তা। অভিযাত্রী জীবনে এ দেশে তো কোনও আর্থিক নিশ্চয়তা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ভুল দেশে ভুল সময়ে ভুল কাজ করছি। কিন্তু আমি অভিযাত্রীই হতে চেয়েছিলাম। ছোট থেকে পরিবারের সঙ্গে বহু বেড়িয়েছি। বেড়ানোর নেশা তখন থেকেই। তারপর চাকরিতে ঢুকেছিলাম ঠিকই কিন্তু ২০০১ সালে সেই চাকরি আমি ছেড়ে দিই। তারপর থেকে শুধুই অভিযান...


নিজের সন্তানকে কীভাবে দেখতে চান?


অনিন্দ্য- আমি ওদের উপর কিছু চাপিয়ে দেব না। ওদের যেটা পছন্দ ওরা সেটাই করবে। তবে হ্যাঁ, আমার জীবনে অনেক না পাওয়া, অনেক লড়াই, অনেক অনিশ্চয়তার পরেও বলব, জীবনকে আমি বাঁচার মতো করে বেঁচেছি তাদেরও সেই শিক্ষাটা দেওয়ারই চেষ্টা করব।



সাক্ষাত্কার শেষ হল। টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন 'অনিন্দ্য দা' থুড়ি আমাদের বস্তু জীবনের 'শঙ্কর'। আবার বদ্ধ ঘর থেকে জগত্ দেখার নেশায় বেরিয়ে পড়বেন তিনি। আমরাও অপেক্ষায় থাকব। বাস্তবের শঙ্করের মুখ থেকে শিহরণ জাগানো নতুন নতুন গল্প শোনার জন্য। সমাজকে শ্বাস নিতে একজন অভিযাত্রীকে যে বড়ই প্রয়োজন। আমাদের জীবনে অনিন্দ্য দা হলে ক্ষতি কী!