দিন কয়েক আগেই হজ থেকে ফিরেছেন। ভেবেছিলেন কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপরই কাজ শুরু করবেন। কিন্তু, দম ফেলার ফুরসত পেলেন কই? সামনেই যে দুর্গাপুজো। তাই অগত্যা কাজে নেমে পড়তেই হল। মণ্ডপসজ্জা থেকে বাজেট কালেকশন...প্রতিটি বিষয়েই নজর রাখতে হচ্ছে তাঁকে। এরসঙ্গে রাজনীতি ও মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব তো রয়েছেই। চরম ব্যস্ততার মাঝে কিছুটা সময় বের করে ২৪ ঘণ্টা ডট কমকে পুজোর আগে একান্ত সাক্ষাত্কার দিলেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ(ববি) হাকিম। অত্যন্ত খোলামেলা সাক্ষাত্কারে যেমন ছিল 'হজ' যাত্রার গল্প, তেমনই আলোচনা ছুঁয়ে গেল রাজনীতি থেকে বিতর্ক। ছিল ২৪ ঘণ্টা ডট কমের পাঠকদের জন্য শারদীয়ার শুভেচ্ছাও। সব নিয়ে কথা বললেন অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর সঙ্গে...


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

প্রশ্ন- সম্প্রতি হজ যাত্রা সেরে ফিরেছেন, কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?


ববি হাকিম- পবিত্র হজের যে অভিজ্ঞতা হয় তা অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। আমরা যা টিভিতে দেখি, তা হল কাবার চারপাশে মানুষ ঘোরেন। কিন্তু, তারপরও থাকে একটা বড় অংশ। সেখানে গিয়ে অত্যন্ত গরমের মধ্যে একটি খোলা মাঠে ৫ দিন সকলকে থাকতে হয়। সেখান থেকে যেতে হয় 'মিনা'তে। এরপর আরাফতের ময়দান হয়ে ফেরার পথে রাস্তায় থাকতে হয় গোটা রাত। পরে শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে, কাবার চারপাশে ঘুরে শেষ হয় এই হজ যাত্রা।


প্রশ্ন- হজ, মহরম থেকে দূর্গাপুজো, কালীপুজো সবেতেই আপনি রয়েছেন, অর্থাত্ সর্বত্রই আপনার একটা 'সেকুলার লুক' রয়েছে। এটা কি অত্যন্ত সচেতনভাবে গড়ে তোলা আপনার 'সেকুলার রাজনৈতিক মুখ'?


ববি হাকিম- যেদিন আমি প্রথম পুজো করেছিলাম, সেদিন আমার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। সেই সময় কি জানতাম, আমি কোন রাজনীতি করব? আদৌ করব কি না? পাঁচ বছর বয়সে প্রথম অঞ্জলি দেওয়ার পাশাপাশি, গোটা স্কুল জীবনে সরস্বতী পুজোর আগে ফেল করার ভয়ে কুল না খেয়ে কাটিয়েছি। তাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রাজনৈতিক সত্ত্বা নয়, রক্তেই রয়েছে ছোটবেলা থেকে। আমার বাবা-মায়ের শিক্ষায় পেয়েছি। (কিছুটা থেমে...) লোক দেখানো সেকুলারিজিমের নাটক বেশিদিন চলে না। এটা ভেতর থেকে আসতে হয়। আমি যেমন উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, তেমনই উগ্র ইসলাম সাম্প্রদায়িকতারও বিরুদ্ধে। দুটোই সমাজের ক্ষতি করে। আমি আমার ধর্মকে বিশ্বাস করি বলেই সমানভাবে অন্য ধর্মকে সম্মান করতে পারি।


প্রশ্ন- ছোটবেলার পুজো আর আজকের পুজো, পরিস্থিতি কতটা বদলেছে?


ববি হাকিম- মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সরস্বতী পুজো দিয়ে হাতেখড়ি। মায়ের বিয়ের শাড়ি চুরি করে পুজো করেছিলাম। সেজন্য মারও খেতে হয়েছে। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পা়ডায় (কলকাতা বন্দর এলাকায়) দুর্গাপুজো, কালীপুজোতে অংশগ্রহণ শুরু হয়। এখন সেখানে কার্যত প্রতিটি পুজোতেই প্রেসিডেন্ট। তাই দায়িত্বও যেমন বেড়েছে, তেমনই কাজের চাপও অনেক। তবুও এটাই জীবনের আনন্দ আমার কাছে।


প্রশ্ন- দূর্গাপুজো, কালীপুজোতে নারী শক্তির আরাধানা করছেন আপনি। সম্প্রতি তিন তালাক নিয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায় নিয়ে আপনার কী মত?


ববি হাকিম- (প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই...) শুনুন, আমাদের দেশে তিন তালাক নিয়ে একটা মস্ত বড় ভুল বোঝাবুঝি আছে। 'শরিয়তি আইনে' তিন তালাক বলে কিছু নেই। অন্যদিকে, তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ক্ষেত্রেও আমার কিছু বলার নেই। কারণ, সেখানে যারা এই মর্মে রায় দিয়েছেন, তাঁরা অনেক ভেবেই তা করেছেন। তাই ভারতীয় হিসেবে সেই রায়ের বিপক্ষে কিছু বলা ঠিক নয়। (উল্লেখ্য তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর, একাধিক রাজনৈতিক দল মুখ খুললেও, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।)


প্রশ্ন- (ধর্ম, সমাজ, সামাজিক সুরক্ষা থেকে এবার রাজনীতির প্রশ্নে...) রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রধান বিরোধী দল কারা? সিপিএম না বিজেপি?


ববি হাকিম- রাজ্যের গ্রামে বা শহরে ঘুরে আমি যেটুকু উপলব্ধি করেছি, পাবলিসিটির(প্রচারের) দিক দিয়ে, ক্যামেরায়, হোর্ডিংয়ে আমাদের বিজেপিকে একনম্বর বিরোধী দল বলা যায়। কিন্তু সংগঠনের বিচারে... এখনও সাংগঠনিক শক্তি, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের দিক থেকে সিপিএম-ই আমাদের প্রধান বিরোধী দল। তা সে ভাঙাচোরা হলেও।


প্রশ্ন- সামনেই দুটি নির্বাচন। ২০১৮-য় রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তারপরই ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন। দল কতটা তৈরি?


ববি হাকিম- ২০১১ থেকেই প্রতিটি নির্বাচনে লড়াই করার জন্য তৈরি রয়েছে দল। গ্রাম থেকে শহর, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি কোনও দলেরই নেই।


প্রশ্ন- আপনি তো দলের বীরভূম জেলা পর্যবেক্ষক?


ববি হাকিম- হ্যাঁ!


প্রশ্ন- বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে নিয়ে কাজ করতে সুবিধা বা অসুবিধা ঠিক কতটা?


ববি হাকিম- অনুব্রত খুব সাদাসিধা, ভালো মানুষ। বড় সংগঠক। দলের বড় মাপের কর্মী। মানুষ হিসেবে অনুব্রতর সঙ্গে কাজ করা খুবই আনন্দদায়ক। কারণ, ও মনে যা ভাবে মুখেও তাই করে। মিডিয়াতে তাঁর পরিচয় হয়তো অন্যরকম, যেমন বিজেপির পরিচয়ও অন্যরকম। ও অনেক লড়াইয়ের সঙ্গে রয়েছে। এর জন্য ওঁকে মারারও চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার।


প্রশ্ন- জেলার নানুরে রাজনৈতিক সমস্যা, তৃণমূল কর্মী গদাধর হাজরা ও কাজল শেখের মধ্যে বার বার গোষ্ঠী সংঘর্ষের অভিযোগ... আসন্ন নির্বাচনে গোষ্ঠী সংঘর্ষ মোকবিলা করার চ্যালেঞ্জ কতটা?


ববি হাকিম- (কিছুটা থেমে...) দেখুন, নানুর নিয়ে যে প্রচার চালানো হচ্ছে তা মিডিয়ার তৈরি। এক সময় নানুরে যে সমস্যা ছিল, তাকেই টেনে এনে এখন নতুন করে কুত্সা ছড়ানো হচ্ছে। আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের 'টিআরপি হাই', তাই আমাদের টেনে এইসব বলা হচ্ছে। প্রথম থেকেই নানুরে সিপিএম-এর গুণ্ডাবাহিনী সন্ত্রাস ছড়িয়ে আসছে। আর দোষ হচ্ছে আমাদের।


প্রশ্ন- তৃণমূল কংগ্রেসের কোর কমিটির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, 'দলে থেকে বিজেপি করা যাবে না।' তাহলে কী দলের অন্দরেই বিজেপিপন্থী মনোভাব তৈরি হয়েছে?


ববি হাকিম- (ঘাড় হেলিয়ে বসে...) নিশ্চিতভাবেই! একজন কর্মী একটি রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় থেকে অন্য দলের কথা ভাববে, সেটা তো আর হতে দেওয়া যায় না। আমাদের দলে এমন কেউ কেউ আছেন (নাম না করেই), যারা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আছি বলে বিজেপির পথে হাঁটছেন। আমি মনে করি, তাঁরা দলের সঙ্গে পাপ করছেন। ফলে, তাঁদের উচিত দ্বিচারিতা না করে দল ছেড়ে চলে যাওয়া।


প্রশ্ন- 'কখনও সারদা, কখনও নারদ'...দলের কয়েকজন হেভিওয়েট নেতার নাম উঠে এসেছে দুর্নীতি মামলায়। ইডি, সিবিআই-এর জেরার সামনাসামনি হতে হয়েছে অনেককেই, এমনকি আপনাকেও। এগুলো দলে কতটা প্রভাব ফেলছে?


ববি হাকিম- দলের ওপর এর প্রভাব কতটা, এটা ভাবার আগে ভাবতে হবে কেনও এই ঘটনা। আমরা (তৃণমূল কংগ্রেস) একটা বড় ষড়যন্ত্রের শিকার। দুর্নীতি কেনও, জীবনে কোনও অন্যায় কাজ আমি করিনি। কিন্তু, কেউ যদি ডোনেশন দিতে এসে, সেটাকে ঘুষ বলে নাটক করে বেড়ায়, তাহলে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আশা করি তদন্তকারী সংস্থা ও আদালত এর ন্যায়বিচার করবে।


প্রশ্ন- নারদ মামলার ফুটেজ কী বিকৃত করা হয়েছে?


ববি হাকিম- দেখুন, এটা সত্যি কথা যে ওই ফুটেজ বহু পুরনো। তাই পুরো ঘটনা মনে নেই। তবে, আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমি যা বলেছি তার সবকিছু এই ফুটেজে নেই। তাই এটা তো পরিষ্কার, সুবিধাভোগীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কিছুটা অংশ কেটে ফুটেজ তৈরি করে নিয়েছেন। আর আসল সত্যি ঘটনার কিছুটা সুবিধামতো বাদ দিয়ে দিয়েছেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে তো ফুটেজে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে-ই।


প্রশ্ন- বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ রাজ্যে এলেন, 'মারের বদলে মার' দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেলেন। কীভাবে দেখছেন?


ববি হাকিম- বাংলা, গুজরাত নয়। অমিত শাহ গুজরাতে যা করেন, এখানে এসে সেই কাজ কোনওভাবেই করতে পারবেন না। বাংলা রবি ঠাকুর, কাজী নজরুল, রামকৃষ্ণের মাটি। বাংলার মানুষ সংস্কৃতিপ্রিয়। তারা কোনওভাবেই সন্ত্রাস বরদাস্ত করে না। অমিত শাহ গুজরাতে বসে এনকাউন্টার করে খুন করেছেন। বিজেপি সরকার কেন্দ্রে দায়িত্বে আসার পর তাঁর ওপর থেকে সেই মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। এবার পশ্চিমবঙ্গে এসে একই কাজ করতে চাইছেন তিনি। বাংলা মানুষ এটা তাঁকে করতে দেবে না।


প্রশ্ন- পুজোয় ছুটি নেই। রাজ্যের মন্ত্রীদের এলাকাতেই থাকতে হবে, নির্দেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই নির্দেশিকার ফলে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জায়গাটা কি আরও পোক্ত হবে?


ববি হাকিম- (মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে) দেখুন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা শুধুমাত্র মন্ত্রীদের একার দায়িত্ব নয়। প্রতিটি এলাকার মানুষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে, বাইরে থেকে কিছু রাজনৈতিক শক্তি আমাদের রাজ্যে ঢুকে পড়েছে। তারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। আটকাতে হবে সেই শক্তিকে। (তিনি নিজে থাকবেন চেতলা অগ্রণীতে)


প্রশ্ন- ৩০ সেপ্টেম্বর দশমী, ১ অক্টোবর মহরম। রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দশমীর পর ফের ২ অক্টোবর থেকে বিসর্জন হবে। ১ অক্টোবর মহরমের জন্য প্রতিমা নিরঞ্জন বন্ধ থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় নেমেছিল বিজেপি। কী বলবেন?


ববি হাকিম- বিজেপি সাম্প্রদায়িক দল। তাই তারা সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছে। ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিয়েছে। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কীভাবে রক্ষা করতে হয়, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন। তাই যেমন দুর্গাপুজোয় আনন্দ করব আমরা, তেমনই মহরমেও মেতে উঠব। এটাই বাংলা।


..... ঘড়ি বাঁধা সময় শেষ। মন্ত্রীর ঘরের বাইরে ভিড় জমে গেছে। দফতরের একের পর এক মিটিং। তবে তাড়াহুড়োর মাঝেই অবশ্য ২৪ ঘণ্টা ডট কমকে পুজোর শুভেচ্ছা জানাতে ভুললেন না ব্যস্ত মন্ত্রী।