সুমন মহাপাত্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

"ক্ষেত্র কুঠি মেসবাড়ি!" না কলকাতা শহরে এই নামে কোনও বড় হোর্ডিং নেই। রাজপথে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চাইলেও পাবেন না। পেরোতে হবে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট। তারপর জরাজীর্ণ এক বাড়িতে এসে ধাক্বা খেলেই বুঝবেন গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছেন। তবে উত্তর কলকাতায় "শিবরামের মেস" বলে হাঁক পাড়লে নবীন ময়রার ওপাশের লোকও আপনাকে ১৩৪, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট যাওয়ার পথ বাতলে দিতে পারেন।



আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: এখনও বারুদের গন্ধ মেলে বিপ্লবীদের 'বোমা বাঁধার ঠিকানা' ২৭ নম্বর কানাই ধর লেনে


মুক্তারামে বসে তক্তারামে শুয়ে শুক্তারাম খেয়ে শিবরাম আজ আর সেখানে বসে নেই। সে বাড়িতে মেস আছে বটে, তবে আতস কাচ দিয়ে খুঁজলেও সেখানে শিবরামকে খুঁজে পাওয়া দায়। কিন্তু এক কালে এই বাড়ির দোতলার ঘরে বসেই একের একের পর এক অফুরান হাস্যরসাত্মক গল্প সৃষ্টি করে গিয়েছেন হাস্যরসের অন্যতম জাদুকর শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলা পাঠকরা ঋণী। তবে শিবরাম অবশ্য ঋণী, রিনির কাছে। হবেন না! জীবনের প্রথম চুমু থেকে প্রথম দাদার প্রাপ্য সম্মান সবই দিয়েছে তো সেই মেয়েটাই।


আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: “বিধান তুমি থাকতে আমার শ্যামা ভুল চিকিৎসায় মারা গেল”


এই গল্প হলেও সত্যি ঘটনার প্লট উত্তরবঙ্গে, রিনির সঙ্গে শিবরামের ছিল মনে মনে প্রেম। সকালে উঠেই মা হাতে দিলেন দুটো বড়ো বড়ো তালশাঁস সন্দেশ। রিনির সঙ্গে ভাগ না করে খাওয়া যায় না। কাজেই হাতে নিয়ে দে ছুট রিনির বাড়ি। দেখেই দুটো সন্দেশ একসঙ্গে রিনির মুখের ভিতর। ভারি বিপত্তি, শিবরাম তো চেখেও দেখেননি। বলতেই, পাখি যেমন ছানাকে খাওয়ায় সেভাবেই সন্দেশ শিবরামকে খাইয়ে দিয়েছিল রিনি। সেটাই মিষ্টিমাখা প্রথম চুমু। তারপর বোনফোঁটাও মিলেছে রিনির থেকে। রিনির মা বললেন, "তোর রামদাকে ফোঁটা দে এবার।" ফোঁটা দিল, প্রণামও করল, কিন্তু আদর আর করল না।


আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: নাটক দিয়েই বিপ্লব হয়! উৎপল নিজেকে বলতেন,"আমি শিল্পী নই, প্রপাগান্ডিস্ট"



লেখকের জীবনে সেই একমাত্র মেয়ে, সেই প্রথম, সেই শেষ। চাঁচোলে দেশবন্ধুর ভাষন শুনে এক কাপড়ে ট্রেনে উঠে কলকাতা এসেছিলেন শিবরাম। চিত্তরঞ্জনের দেওয়া ১০ টাকায় বই-খাতা না কিনে সিনেমা দেখে খেয়ে উড়িয়ে দিলেন। তারপর মেস ম্যানেজারের কড়া ধমকে ভবঘুরে হলেন খাদ্য রসিক রামদা। অবশেষে লঙ্গরখানার খাবার, আর ফুটপাত ঠিকানা হলো শিবরামের। এরপর খবরের কাগজ ফেরি করা শুরু। তবে যা রোজগার সবই পেটপুজোয় খতম। তখনই ক্ষেত্র কুঠিতে ঠাঁই হয়েছে শিবরামের।


আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: নিজেকে হিন্দু না বলে, মুসলমানের সঙ্গে সমস্ত প্রভেদ উচ্ছেদ করে দিই তাহলে...


বন্দেমাতরম বলতে বলতে একবার জেলে গিয়েছিলেন শিবরাম। ব্যতিক্রমী নাকি মিষ্টির টান? সেখানে দেখা হয়ে গিয়েছিল পুরনো প্রেম রিনির সঙ্গে। যাই হোক অর্থাভাব কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিলেন দেশবন্ধু। তাঁর সুপারিশে শিবরামের পাকাপাকি কাজ মিলল নেতাজির আত্মশক্তি পত্রিকায়। কিন্তু বাঁধা-ধরা আফিসে অ্যালার্জি শিবরামের। নেতাজির হুঁশিয়ারি থোড়াই কেয়ার! অতএব যা হবার তাই হলো, চাকরিহারা শিবরাম। চাকরি হারালে লোকে কষ্ট-দুঃখ পায়। শিবরাম যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টিমুখ।


আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: ফ্যাতাড়ুরা যে কখন বিস্ফোরণ ঘটাবে সরকারও টের পাবে না!


তবে কাজ হারালেও গুণীর কাজের অভাব হয় না। পত্রিকার আফিস ছেড়ে নিজেই হলেন পত্রিকার মালিক। মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে কিনে নিলেন যুগান্তর পত্রিকা। কিন্তু অত সুখ কি কপালে সয়! রাজরোষে ফের হাজতবাস। তবে হাজতে যাওয়ার আগে টপাটপ মিষ্টি খেতে ভোলেনিন রসিক শিবরাম। প্রেসিডেন্সি ঘুরে এবার তাঁর ঠিকানা হলো বহরমপুর জেলে। সেখানেও উলট-পুরাণ! জেলে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হবে ভেবেই আপ্লুত শিবরাম। তবে কাজীর খানার লোভনীয় বর্ণনা এরকম, "মনে পড়লে এখনও জিভে জল সরে। নিজেকে সজিভ বোধ করি! আর জেলখানার সেই খানা। আহা! আমি তো বহরমপুর জেলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টিঙটিঙে রোগা ছিলাম। তারপর কাজীর খানা খেয়ে এমন মোগলাই চেহারা নিয়ে বের হলাম যে আর রোগা হলাম না।"



 


আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: প্রেম, দাম্পত্য, বিচ্ছেদ- তসলিমাকে নিজের হাতে গড়েছিলেন কবি রুদ্র


তবে তাঁর কথা অনুযায়ী তিনি লেখক হয়েছেন পেটের দায়ে। "গায়ের জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই।" একটু পেয়ারা সন্দেশ কিংবা রাবড়ি খাওয়ার জেদেই কলম ধরলেও কথা বলে তাঁর কালি। সেই কলমের নিপ হাস্যরস আঁকে। যার ছোয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনরা। তাঁর লেখা কালজয়ী মানতে নারাজ খোদ তিনি। বরং তিনি ছোট লেখক। ছোটরা তাঁর লেখা পড়বে বড় হলে ভুলে যাবে, এই ছিল তাঁর বাসনা।



আরও পড়ুন: গল্পস্বল্প: জহরের কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে সুচিত্রা সেন বলেছিলেন, তুমি চলে গেলে চার্লি!


কিন্তু হাস্যরসের আড়ালেও তাঁর জীবন "ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসার" মানে বোঝায়। আজ যখন ধর্ম নিয়ে খাইখাই তখন যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক শিবরামের মন্দির, মসজিদ, গির্জা না বানিয়ে পায়খানা বানানোর কথা। যেখানে সর্বধর্ম সমন্বয় হবে। ব্যাঙ্কে কখনই খাতা ছিল না তাঁর। বাড়ির খাতাতেও হিসেব লিখতেন না। হিসাব লিখতেন দেওয়ালে। চুন-সুড়কির উপর রংয়ের প্রলেপে সে হিসাবের ধ্বংসাবশেষ প্রহেলিকার মতো পড়ে রয়েছে ক্ষেত্র কুঠিরে। হঠাৎ হঠাৎ শুধুমাত্র কিছু ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ফ্রেমবন্দি করে তাকে। সংরক্ষণের বালাই নেই, কালের নিয়মে যুগের দুরন্ত গতির কাছে হার মেনে ধুঁকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষেত্র কুঠির। ঠিক যেভাবে মৃত্যুর ৫ মিনিট আগে "ফার্স্টক্লাস" আছি বলে চলে গিয়েছিলেন শিবরাম। মুক্তারামে ঢুঁ মারলে আজও দেখা মেলে সেকালের শিশুদের সঙ্গে, যাদের জানালা দিয়ে চিনি রুটি দিতেন রাবড়ির নেশাড়ু শিবরাম দাদাবাবু।