সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আমরা যারা আশির দশকে বালকবেলা কাটিয়েছি এবং স্বভাবতই নব্বইয়ের দশকে আবেগ-থরোথরো কৈশোরকাল, তারা প্রথম কার জন্যে কেঁদেছি? প্রথম কার ছবি কেটে-কেটে জমাতে শিখেছি? বয়ঃসন্ধির শরীরীআবেগের মধ্যেও প্রথম কোন পুরুষকে অবলীলায় স্বপ্নে দেখেছি? কার জন্যে গলার শির ফুলিয়ে বড়দের আসরেও বেমানান ভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি? 


মারাদোনা-মারাদোনা-মারাদানা-মারাদোনা!



মারাদোনা জানেন আমার প্রথম সব কিছু! তিনি আমাদের হিরো, তিনি আমাদের স্বপ্ন, তিনি আমাদের কল্পনা, তিনি আমাদের মুক্তি, তিনি আমাদের আলো, তিনি আমাদের ম্যাজিশিয়ান, তিনি আমাদের প্রতিবাদ, তিনি আমাদের যন্ত্রণা, তিনি আমাদের উল্লাস, তিনি আমাদের ঈশ্বরও!


উত্তর কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে তখন টিভি তো চরম পরম বিলাসিতা। ১৯৮২-র ফুটবল বিশ্বকাপ তাই ছেড়েই দিলাম। কিন্তু ১৯৮৬? না, তখনও টিভি ঘরে-ঘরে সুলভ নয়। তবু তারই মধ্যে পাড়াতুতো দাদা বা কাকাকে পাকড়ে তার কাছে টিভির সামনে বসার টিকিট ফিক্স করে ফেলার সেই অপূর্ব দিনগুলি ভোলা যায়! 


আর টিভির সামনে কোনওক্রমে বসে পড়তে পারলেই ম্যাজিক! সারাক্ষণ একটা সবুজ মাঠের মধ্যে তখন ম্যাজিক দেখাচ্ছেন এক পাঁচ ফুটের ঈশ্বর! অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, যিনি রুমাল-পরিমাণ জায়গায় ৪-৫ জন ডিফেন্ডারকে অনায়াসে ডিব্রল করে বল নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন! যিনি ফুটবলের যে কোনও মানের যান্ত্রিকতাকে অনায়াসে ভেঙেচুরে বাড়াতে পারেন অলৌকিক সব পাস! যাঁর 'বাম'পন্থী ফুটবল থেকে বেরিয়ে আসে জগৎপ্লাবী আলোর ঝরনাধারা!



এঁর ছবি কেটে না রাখলে চলে! এঁর জন্য না কাঁদলে চলে!


যিনি সম্পূর্ণ একার কাঁধে ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে তুলে দিলেন ফাইনালে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। জিতল জার্মানি। আমাদের ঈশ্বর কাঁদতে-কাঁদতে মাঠ ছাড়লেন। আমরা না কেঁদে তখন বাঁচি কী করে? শুধু কি সে-বারই! পরের বারে, ১৯৯৪ সালে গ্রিসের বিরুদ্ধে কথা বলে উঠল তাঁর বাঁ পা। একটা অসাধারণ 'বাম'পন্থী গোল আমরা দেখলাম। কিন্তু তার পরেই তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। মাদক-কাণ্ডে তাঁর মুখের সামনে বন্ধ হয়ে গেল বিশ্বকাপের দরজা। আমাদেরও মুখের ওপরে যেন কে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তখনও কি কাঁদিনি আমরা! তখন তো একটু বড় হয়েছি, কাঁদতে লজ্জা করে, কিন্তু তা-ও! ঈশ্বর কাঁদিয়েছেন, আমরা তো নিমিত্তমাত্র।


সবুজ মাঠ থেকে চলে গেলেন ঈশ্বর। তাতেই কি সব শেষ হল? ক্রিকেটে একটা কথা আছে, যিনি শুধু স্কোরবোর্ডই জানেন, তিনি ক্রিকেটের কী জানেন! না, সেই বয়সেই সবটা বুঝিনি। কিন্তু পরে পরে ঈশ্বরের নানা বিভূতি আমাদের সামনে একটু-একটু করে প্রকাশিত হয়েছে। 


৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার কী জানা যায়? কী ভাবে জানা যাবে, বরাবরের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঈশ্বর নিজের খ্যাতি-প্রতিপত্তিকে কখনও ম্যানিপুলেট করেননি, বরাবর অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলেছেন। ফিফার সঙ্গে সংঘাতে গিয়েছেন। ক্ষমতার ঘুঁটিগুলিকে আক্রমণ করেছেন। বিপন্ন হয়েছেন, লড়াই ছাড়েননি। এসব অবশ্য তখন বুঝিনি। যিনি অভাব আর স্কিল একসঙ্গে দুটোকে নিয়েই বড় হয়েছেন তিনি পেশাদার জীবনে এভারেস্টে চড়ে বসলেও তাঁর শিকড়কে কখনও ভোলেননি, ভুলতে চাননি। যে-বস্তিতে থেকে যে-সব অশিক্ষিত গরিব নেশাড়ু কিশোরদের সঙ্গে তাঁর বড় হয়ে ওঠা কখনও মানসিক ভাবে তিনি তাঁদের থেকে বঞ্চিত হননি। এসব অবশ্য তখন বুঝিনি। কেন চে গেভেরার উল্কি ঈশ্বরের বাহুতে? কেন পায়ের পেশিতে ফিদেল? শিশুর মতো সরল ও উদাসীন এক ফুটবলশিল্পী, যিনি জগৎ ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা 'উইথ দ্য বল' নানা রকম কেরামতিতে বুঁদ হয়ে থাকেন, তিনি যে কতটা প্রখর ভাবে রাজনৈতিক সচেতন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষ, তখন বুঝিনি। যিনি তাঁর দেশ, তাঁর দেশের মাটি, সংস্কৃতি, দেশের ভাষা নিয়ে সদা-গর্বিত, যিনি বিশ্বের সর্বত্র স্প্যানিশে কথা বলেন (জানলেও অন্য ভাষা বলেন না), তিনি কি নিছকই একজন ফুটবলার? যিনি ফুটবলারদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বরাবর গলা ফাটিয়েছেন, তিনি কি শুধুই একজন রেকর্ডধারী খেলোয়াড়? 


যুগ্মভাবে শতাব্দীর সেরা ফুটবল প্লেয়ার। তাঁর গোল শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে চিহ্নিত। মাঠের বাইরের প্রতিকূল জীবনের কথা বাদ দিলেও মাঠের মধ্যে নিয়ত তাঁকে যে প্রতিরোধের মধ্যে পড়তে হত সে কথা কি ভোলা যায়? শুধু ১৯৮৬-র বিশ্বকাপেই ৫৩ বার ফাউল করা হয়েছিল তাঁকে! অথচ, তিনি ঈশ্বর বলেই সেই প্রতিরোধের মুখে পড়েও ৯০ বার বল নিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন! তাঁর সময়ে তাঁর সঙ্গে যাঁরা খেলেছে তাঁরা যত বড় ফুটবলারই হোন না কেন, তাঁর তুলনায় তাঁরা লিলিপুট। অথচ, এই লিলিপুটদের নিয়েই তিনি কী দুরন্ত ম্যাজিকই যে দেখাতেন। বড় বড় ক্লাব ছেড়ে গেলেন ইতালির নাপোলিতে। সেখানে একটা সেকেন্ড ডিভিশন দলকে ফার্স্ট ডিভিশনে তুলে তাকে চ্যাম্পিয়নও করলেন! ঈশ্বর ছাড়া সম্ভব? 


আমরা তাই কোনও দিনই 'পেলে বড় না মারাদোনা বড়' এসব বালখিল্য আলোচনায় নড়ে যাইনি। আমরা একটা কথাই জানি, ঈশ্বরের কোনও তুলনা হয় না, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়! 


আরও পড়ুন:  ভাষাতত্ত্বের গণ্ডিতেই নিজেকে বন্দি রাখেননি সজীব মনের মানুষ সুনীতিকুমার