অরিণ মুখার্জী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

প্রত্যেকটা পাড়ারই একটা গন্ধ থাকে। এমনি সময় হয়তো বোঝা যায় না, হয়তো ঠিক সন্ধ্যে নামার মুহূর্তে রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ গন্ধগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। জানান দেয় তার স্বতন্ত্র সত্ত্বার।


শুধু কলেজ স্ট্রিট কিংবা ডেকার্স লেন নয়, অনামি, ব্যাক্তিগত পাড়াগুলোরও একদম নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে, শব্দ থাকে, পরিচয় থাকে। মনে আছে, ছোটবেলায় বিকেলে মাঠে ফুটবল পেটানোর শেষে চেনা গন্ধটা নাকে আসত, তখন বাড়ি ফেরার সময়। দোকানগুলোয় সন্ধ্যে দেওয়ার গন্ধ, পাড়ার মন্দিরে ধুপ-ধুনোর গন্ধর সাথে মিশে যেত হরিদার মিস্টির দোকানের সিঙ্গারা ভাজার গন্ধ। গন্ধটার সাথে কেমন যেন মন খারাপ মিশে যেত। তখন সবে সন্ধ্যে নামছে শহরে। পাড়ার মোড়ে ক্যারামটা পাতা হচ্ছে, জ্বালানো হচ্ছে একটা হলদেটে আলো। ঐ আসরে থাকার অনুমতি ছিল না আমাদের, পড়তে বসতে হবে, ওটা একটু বড়দের জন্য। সন্ধ্যেটা আর একটু জমে গেলে রকে এসে বসবে আপিস ফেরত আরও বড়দের দল। বছরের পর বছর এভাবেই চলেছে, এভাবেই সময় থমকে থেকেছে। সময়কে থমকে দিতে জানত আমার শহর।


ঠিক সকাল আটটার সময় বার্লি কারখানায় ভোঁ বাজত, প্রথমবার। আমরা জানতাম ওটা সিগন্যাল, দিন শুরুর। কারখানায় যারা কাজ করে তাদের, আর আমারও। স্কুলে যেতে হবে, ওদিকে ভাত ফোটানোর গন্ধ আসত রান্নাঘর থেকে। কারখানার একটা ভোঁ যেন তার প্রবল পৌরুষের অবাক করা ম্যাজিকে অলস মধ্যবিত্ত নিস্তরঙ্গ সকালটাকে কর্মব্যস্ত দিন করে দিত। সকালের আড্ডাগুলো ভেঙ্গে যেত , সকালের আলতো আলস্য কাটিয়ে জেগে উঠত সবাই। যন্ত্রসভ্যতা প্রবল পরাক্রমে বিজয়বার্তা শোনাত প্রতিদিন।


এটা নব্বই দশকের গল্প, কিংবা বলা যায় গল্প হলেও সত্যি। বাংলা সিনেমা বাদ দিয়ে কোথাও নস্টালজিয়া পাত্তা পায়না আজকাল। তাছাড়া নস্টালজিয়ারও প্যাকেজিংটা ভাল হওয়া দরকার, না হলে চলে না একেবারেই। হরিদার দোকানেও এখন সিঙ্গারা ভাজা হয় না। দোকানটাই উঠে গেছে অনেকদিন হল। পাড়ার মোড় থেকে একটু এগোলেই শহরের এক নামী মিস্টির দোকানের ফ্র্যাঞ্চাইজি খুলেছে, বিক্রিবাটা ভালই হয়। পুরনো দোকানগুলো কয়েকটা উঠে গেছে, দু-চারটে আছে এখনো, ধুলোপড়া, পুরনো বাল্ব জ্বলে। নতুন ঝাঁ চকচকে শপিং মলের শহরে একেবারে মিসম্যাচ, রকে আড্ডা মারা লোকগুলোর মতই। রকগুলো আজকাল একা একাই থাকে, নিঃসঙ্গ। ইঁদুরদৌড়ে ব্যস্ত শহরের তাকে দেওয়ার মত সময় নেই। বার্লি কারখানার বেশীটা জুড়েই এক আকাশ ছোঁয়া বহুতল। কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেছিল, লক আউট হয়েছিল বোধহয়, ঠিক মনে নেই। মনে থাকার কথাও ছিল না। সকালবেলা ভোঁ শুনে যারা দৌড়ত তাদের কি হয়েছে তাও কেউ মনে রাখেনি, আমারইবা কি দায় পড়েছে মনে রাখার।


তবুও আকাশছোঁয়া বহুতলের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে যদি কাউকে ঘোলাটে ভাষাহীন চোখে চকচকে বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকতে দেখি হঠাৎ মনে হয়, এও হয়তো তাদের একজন। বাঘারুদের সংখ্যাকি বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন? কিংবা হয়তো আমার ভুল, সেও আমারই মত, গ্যালারিতে বসে থাকা এক দর্শক মাত্র। এখনো হঠাৎ কোনো কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা আবার সেই চেনা মন খারাপের গন্ধটা ভেসে আসে। খোঁজবার চেষ্টা করি, কিছু খুঁজে পাই না, খুঁজে পাওয়া যায়না, আসলে গন্ধটা বোধহয় সময়ের।