সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

যে কোনও শিল্পেই 'রূপক' বলে একটা বিষয় হয়।  'রূপক' মানে, সেখানে আপাতদৃষ্টিতে যা বলা হচ্ছে, সেটাই এক ও একমাত্র বক্তব্য থাকছে না, কিংবা আদপেই সেটি কোনও বক্তব্য না হতেও পারে; বরং ওই বাইরের ত্বক-খোসায় যা বলা হচ্ছে, শাঁসের নিভৃত অন্তরে নিহিত থাকছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনও ভুবন, অন্য কোনও দিশা!


এ হেন রূপকের আবার মাত্রান্তরও হয়। রূপককে সেই মাত্রান্তরেই হয়তো দেখা গিয়েছিল সদ্য প্রয়াত নারায়ণ দেবনাথের কমিক্সে। 'মাত্রান্তর' মানে, তীব্রতাটা কম, বা, অভিঘাতটা একটু 'টোন ডাউন' করা। 


কী রকম?


একটু ব্যাখ্যা করা যাক। কমিক্স, আমরা সততই জানি তা, ছোটদের জন্য, ছোটদের মতো; ছোটদের জগতের নিবিড় মেঘ ও রোদ্দুর সতত সঞ্চরমাণ সেখানে। বড়দের প্রবেশ সেখানে নিষেধ। 'প্রবেশ নিষেধ' মানে, ছোটদের কাহিনি যা নিয়ে ছুটবে সেখানে থাকবে না বৃহত্তর বিশ্বের বড়সড় কোনও ঘটনার বিন্দুমাত্র অনুষঙ্গ। আবিশ্বে শিশুকিশোর সাহিত্যের জগতে মোটামুটি এইটিই বহাল থেকেছে। কখনও কখনও যে তার সচেতন বিচ্যুতি ঘটেনি, তা নয়; কিন্তু মোটামুটি ভাবে তা ছোটদের পৃথিবীর দিকেই মুখ করে থেকেছে। 


আজীবন শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে-চলা এঁকে-যাওয়া এই মানুষটিও কি ঠিক তাই-ই করেননি? ছোটদের পৃথিবীর দিকেই মুখ করে থাকা? তাঁর শিল্পের যে জগৎ, তাঁর ভাবনার যে ভূগোল, তাঁর কল্পনার যে রসায়ন, তাঁর সৃষ্টির যে দর্শন-- সেখানেও সততই গভীর ছায়া ফেলে গিয়েছে শৈশবের অম্লান রোদ্দুর, কৈশোরের অমেয় দুষ্টুমি। আর সেখানে অতিরিক্ত যা ছিল, তা হল, একটা খাপছাড়া অদ্ভুতুড়েপনা, একটা কুয়্য়ার অ্য়াম্বিয়েন্স বা ইনসিডেন্ট বা অকারেন্সের আবহ। মূলত বাঁটুলের কার্য-কলাপের সঙ্গেই যা অন্বিত।


কিন্তু সাহিত্যসংক্রান্ত কিছু গবেষণা তথ্য়সন্ধান করে দেখিয়েছে-- নারায়ণ দেবনাথ তাঁর জন্য নির্দিষ্ট এই চৌহদ্দির মধ্য়েই যেন অনেকটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেন; প্রথাগত শিশুকিশোর সাহিত্যের বিধিবদ্ধ 'জঁর' থেকে সচেতন ভাবে সরে আসেন, বা ঠিক সরে না-এসে, চেনা কমিক্সের চেনা মাটিতে পা রেখেই তিনি সাবলীল ভাবে সেখানে গুঁজে দেন ছোটদের তথাকথিত অচেনা একটা সমাজ-রাজনীতির অন্য়তর ভুবন, ভিন্নতর ভাবনা-বিশ্ব।
      
কী রকম ভাবে, তার এবার একটু উদাহরণ নেওয়া যাক। সবাই জানে, কমিক্সে ভায়োলেন্স নৈব নৈব চ। অথচ, কমিক্সের প্যাটার্নে এবং প্যারামিটারের ভিতরে দাঁড়িয়ে থেকেও নারায়ণ দেবনাথ তাঁর বাঁটুল চরিত্রে আনেন নানা শেডস। সেই শেডসে এমনকী মিশে যায় ব্লাডশেডের ভয়াল ছবিও, মিশে যায় মৃত্যুদৃশ্যের আতঙ্ক! 


কেন? কীভাবে? 
  
আসলে বাঁটুলকে নারায়ণ দেবনাথ বরাবরই একটু সমসাময়িকতার আঙ্গিকে এঁকেছেন বলেই দেখা গিয়েছে। তিনি এজন্য বাঁটুলকে যুদ্ধেও পাঠিয়েছেন! উল্লেখ্য যে, তিনি যখন তাঁর বাঁটুল দ্য গ্রেট নিয়ে বাংলা সাহিত্যে পা রাখলেন তখন বাতাসে বারুদের গন্ধ, সময়টা ১৯৬৫ সাল। ভারত-পাক যুদ্ধের কাল। তিনি একটুও দ্বিধা না করে বাঁটুলকে তাই পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এই ট্রেন্ড বজায় থেকেছে ১৯৭১ সালেও। সেটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখনও বাতাসে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব, সাধারণ মানুষের মনের ভিতরে জাতীয়তাবাদী আবেগের ঢেউ। তখনও নারায়ণ বিষয়ের খোঁজে অন্য দিকে চোখ ফেরান না। বাঁটুলকে সটান পাঠিয়ে দিলেন খানসেনা নিধনে।


এই ১৯৭১-এর যুদ্ধেই বাঁটুলের দ্বারা সম্পাদিত ধ্বংসলীলা প্রথম একটু 'ভায়োলেন্ট' হয়ে উঠল। এই পর্বেই নারায়ণ তাঁর কমিক্সে সরাসরি মৃত্যু দেখালেন, এমনকী ব্লাডশেডও দেখালেন! তবে এই প্রথম, আর এই শেষ। পরবর্তী সময়ে নারায়ণ বাঁটুলকে অপারেশন বিজয় বা কার্গিল যুদ্ধেও অংশ নেওয়ান। না, সেখানে আর তত ভায়োলেন্স দেখান না। কিন্তু যুদ্ধ-রাজনীতি, দেশ-সমাজের একটা গন্ধ তিনি মসৃণ ভাবে বিছিয়েই রাখেন তাঁর সৃষ্টিতে। যেটা তাঁর শিল্পের উৎকর্ষের গুণে চোখে লাগে না, কিন্তু তা একটা আপাত অন্তর্ঘাত রেখেই দেয়। অর্থাৎ, প্রথম পড়ার আবেশ-উন্মাদনাকে পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে যখন ছোটরা আবার সেগুলি ফিরে পড়বে, তখন তারা হয়তো তাদের চারপাশের সমাজ-বিশ্বকে নিয়ে ভাববে, ভাববার একটা অবকাশ অন্তত তৈরি হবে। 


একজন সচেতন শিল্পী হিসেবে নারায়ণ আসলে তাঁর ছোট্ট ছোট্ট পাঠকদের 'ভাবা প্র্যাকটিস' করান! বোঝা যায়, নারায়ণ তাঁর টার্গেট অডিয়েন্সকে খুবই সিরিয়াসলি নিচ্ছেন, ছোটদের তিনি নিছক ছোট বলেই 'ছোট' করে রাখছেন না; তাদের রীতিমতো গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি, তাই তাদের মননে বিনোদনের হালকা মোড়কেই বুনে দিচ্ছেন দেশ-সমাজ-রাজনীতির আবেশ, গেঁথে দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদী বোধ।


নারায়ণ কি তবে চাইছিলেন তাঁর অল্পবয়সী পাঠক-পাঠিকারা তাঁকে পড়তে-পড়তেই একটু বড় হয়ে যাক? হয়ে উঠুক একটু সাবালক?     


Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 


আরও পড়ুন: Narayan Debnath: নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুর সঙ্গেই কি মৃত্যু হল বাঙালির প্রথম সুপারহিরোর?