Poila Baisakh: ওয়াশরুম-পর্বে পৌঁছেই কি `ওয়াশড আউট` হয়ে গেল বাকি থাকা বাঙালিয়ানাটুকু?
একটা বড় বাড়িতে পর পর ঘরে বসবাস করা অনেকগুলি মানুষ মিলে একটি একান্নবর্তী পরিবার। যেখানে সকলে একসঙ্গে খায়-শোয়-ওঠে-বসে। আড্ডা এবং ঝগড়া সমান স্পন্দনের সঙ্গে করে।
সৌমিত্র সেন
বাঙালিয়ানার বিবর্তনকে সহজে, এককথায় ওয়ানলাইনে কী ভাবে ধরা যায়? রসিকজনেরা কিঞ্চিৎ তির্যকতার সঙ্গে বলে থাকেন-- ব্যাপারটা নাকি অব্যর্থ ধরা যায় 'কমন বাথরুম' থেকে 'অ্যাটাচড বাথ' রূপকল্পে!
কী ভাবে?
'কমন বাথরুম' হল গিয়ে সোজা ভাষায় 'কলঘর'। যে কলঘর মধ্যবিত্ত বাঙালির দৈনন্দিনতার সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। ধনী-দরিদ্রের বিষয়ই এটা নয়; বিষয়টি ছিল স্রেফ মনোভঙ্গির, যাপনচরিত্রের।
(পরিবারের কোনও একজনের বিশেষ আর্থিক) ক্ষমতা থাকলেও একত্রে একই বসতবাড়িতে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে একটু মানিয়ে-গুনিয়ে একই ঘর-বারান্দা-ছাদ, একই উঠোন-কলঘর সানন্দে ব্যবহার করে সকলের সঙ্গে হাসিমুখে মিলেমিশে থাকা! এটাকে যাপনচিত্রও বলা চলে। একটা বড় বাড়িতে পর পর ঘরে বসবাস করা অনেকগুলি মানুষ মিলে একটি একান্নবর্তী পরিবার। যেখানে সকলে একসঙ্গে খায়-শোয়-ওঠে-বসে। আড্ডা এবং ঝগড়া সমান স্পন্দনের সঙ্গে করে।
তবে এদের সব চেয়ে বড় শ্রেণিদ্বন্দ্ব তৈরি হয় কলঘরের দরজায় এসে। তখন সমস্ত সাম্যকে ক্ষণিকের জন্য উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের মূর্তিমান প্রতিমূর্তি হয়ে উঠে এঁরা প্রত্যেকে কে সকাল সকাল কলঘরটি দখল করবেন, সেই প্রতিযোগিতায় নামেন! কে দ্রুত নিজের প্রাতঃকৃত্য় সেরে দৈনন্দিকর্মে লিপ্ত হতে পারবেন সেই সংগ্রামে নামেন। ঠিক এরকমই একটি ছবি তপন সিনহার কাল্ট 'গল্প হলেও সত্যি' ছবিতে দেখা গিয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ছবিতে সেই সময়কার বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের একনিষ্ঠ ছবিই ধরা পড়েছিল সন্দেহ নেই। সে ছবি ছিল বড় মধুর, বড়ই নয়নলোভন। 'কমন বাথরুম' বা কলঘরটি আপাত দৃষ্টিতে যেন ওই পরিবারটির 'বোন অফ কনটেনশন'; যাকে ঘিরে একটা ছদ্ম ঝগড়ার আবহ তৈরি হচ্ছে, অথচ, তার খানিক বাদে, লম্বা বারান্দায় খেতে বসেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি! তিক্ততা তখন যেন কোন বহুযুগের ওপারের বস্তু। বড়ভাই তখন তাঁর গিন্নিকে সহাস্যে অনুরোধ করছেন ছোটভাইয়ের পাতে কোনও বিশেষ পদ একটু বেশি দিতে, কেননা, সে সেটি একটু বেশি ভালোবাসে!
বাঙালি সংসারের এই অতি মধুর ছবিটি এখন আর দেখাই যায় না। দেখার প্রায় কোনও সুযোগই নেই! কেননা, এখন (ঠিক 'এখন' নয়, দেখতে গেলে বহুদিনই) একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়ে এসেছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি; উঠোন বা বারান্দার কোণে পড়ে থাকা বিবর্ণ কলঘরটি মুছে গিয়ে এসে গিয়েছে অ্যাটাচ্ড বাথ; না একটু ভুল হল হয়তো, এখন তো বিষয়টা 'বাথরুম' 'টয়লেট' 'লু' ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে আরও সফিস্টিকেটেড ও দুরস্ত 'ওয়াশরুমে' পর্যবসিত হয়েছে। যেখানে এসে সমস্ত বাঙালিয়ানাই প্রায় ধুয়ে গিয়েছে, যাকে বলে একেবারে 'ওয়াশড আউট' হয়ে গিয়েছে!
আরও পড়ুন: Poila Baisakh: বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে আজও কি নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ?