সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কেভিন ডয়েল 'ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট রেভলিউশনে'র পক্ষে নোয়াম চমস্কির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে 'নৈরাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, মার্কসবাদ' বিষয়ে কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গক্রমে মনুষ্যস্বভাবের ধাঁচ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন-- 'ভাষার কথাই ধরুন না; (প্রতিটি ভাষার মধ্যে ফারাক থাকলেও) সব রকম ভাষার মধ্যেই একধরনের মিল রয়েছে। মঙ্গলগ্রহের কোনও বিজ্ঞানীর কাছে মনে হতেই পারে, মানুষের ভাষা একটাই-- শুধু স্থান-কাল-পাত্রের ভেদে তার কিছু ছোটখাট পরিবর্তন হয়েছে মাত্র! কেন তাঁর এরকম মনে হতে পারে? এর কারণ হল, ভাষার বিকাশে মনুষ্যস্বভাবের এক বিশেষ অংশ কাজ করে। কোনও ভাষাই তার (মনুষ্যস্বভাবের) আওতার বাইরে যেতে পারে না।'


এই পর্যন্ত বলে নোয়াম নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, 'এটা কি তবে ভাষার সীমাবদ্ধতা?' উত্তর দেন-- 'অবশ্যই'। আবার নিজেই প্রশ্ন করেন, 'এটা কি ভাষার সীমার অতিক্রমণও?' নিজেই উত্তর দেন-- 'হ্যাঁ, অবশ্যই।' (ভাষার) এই সীমাবদ্ধতার ফলেই বিবিধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু মূলগত ঐক্য়ের মধ্যে (ভাষার) সূক্ষ্ম ও সমৃদ্ধ এক প্রকাশতন্ত্র গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।


এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে সূত্র নিয়ে 'ভাষার বিকাশে মনুষ্যস্বভাবের প্রভাবে'র বিষয়টিতে আমরা ঢুকব। এবং ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই এটা স্বীকার করে নেব যে, একটা ভাষার মধ্যে এই যে মনুষ্যস্বভাবের অংশ কাজ করে, সেটাই আসলে যে কোনও ভাষাকে সমৃদ্ধ করে চলে। এটাই সেই ভাষাটিকে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। 
'পয়লা বৈশাখ' তো আমাদের অন্যতম সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান। আর ভাষা ও সংস্কৃতি তো পরস্পর ওতপ্রোত। ফলে এই পয়লা বৈশাখে আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা নিজেদের ভাষা নিয়ে, ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে দু'দণ্ড ভাবতেই পারি। দেখে নিতেই পারি, এখন আমাদের ভাষাটি ঠিক কেমন করে বেঁচে আছে, কতটা বেঁচে আছে। 


সেটা দেখে বা বুঝে নিতে গেলে আমরা একটু ক্যাটেগরিক্যালি বিষয়টায় পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করি বরং। এবং তর্কাতীত ভাবে স্বীকার করে নিই যে, যে কোনও ভাষা জোরের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে তার দীর্ঘ গভীর নিরন্তর বৈচিত্র্যময় চর্চার মধ্যে দিয়েই শুধু। এবং এর সঙ্গে এটাও লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করি যে, এই মুহূর্তে আমরা বাঙালিরা মোটেই আমাদের 'অতি প্রিয়' (?) এই ভাষাটির তন্নিষ্ঠ চর্চায় রত নেই।


ইদানীং আমরা সেভাবে প্রিন্ট মেটেরিয়াল পড়ি না। নিখাদ সাহিত্যচর্চা তো ছেড়েই দিলাম। খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যেসই আর সেভাবে দেখা যায় না। বাঙালি ছেলেমেয়েরা কথা বলতে গেলে অর্ধেক ইংরেজি-হিন্দি বুলি কপচায়। বন্ধুরা রসিকতা করে কিছু করলে-বললে উত্তরে তারা 'কুছ ভি' বলে হাসে! শুধু মুখেই নয়, লিখিত বাংলায় পর্যন্ত 'কেননা'র পরিবর্তে অবলীলায় 'কেনকি' ব্যবহার করে। লিখতে গিয়ে হরবখত 'পড়া' আর 'পরা' গুলিয়ে ফেলে। ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান তো আলমারির ভল্টে ঢুকে গিয়েছে। 'ভুঁড়ি' ও 'ভূরি' যে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি জিনিস, তা শুনলে আকাশ থেকে পড়ে। দীর্ঘায়িত দৃষ্টান্ত বাঞ্ছনীয় নয়। মোদ্দা কথা, জ্ঞানের অভাব নয়, নিজের ভাষার প্রতি ন্যূনতম ভালোবাসা মমতা মনোযোগের অভাব। 


ইদানীং আর একটি বিষয় খুব দেখা যাচ্ছে। মানুষ ক্রমশ চিহ্নবাদী হয়ে উঠছে। ভাষার বিকাশের আগে মানুষ অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করত। সেটাই কি একটু অন্য রকম ভঙ্গিতে ফিরছে? না হলে মানুষ এখন এত ইমোজি ব্যবহার করে কথা বলে (পড়ুন 'লেখে') কেন? একালের বাঙালি কি এই ভাবেই লিপিময় কিন্তু ভাষা-হীন এক দুর্বোধ্যতার দিকে ছুটছে? জীবনানন্দ তাঁর গদ্যে একটা অদ্ভুত ফ্রেজ খুব ব্যবহার করতেন-- 'কথা ভাবা'! এ ক্ষেত্রে সেই জীবনানন্দীয় লব্জ ধার করে কি বলা যায় না, এখন বাঙালি আর মোটেই কথা ভাবছে না? চটপট সহজলভ্য কিছু চিহ্ন, সংকেত, ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করে ফেলছে! তা হলে ভাষাটি সমৃদ্ধ হবে কীভাবে? একমাত্র চর্চার মধ্যে দিয়েই তরতর করে ভাষা এগিয়ে যায়।


ইংরেজি মাধ্যমে পড়াটাকে আর দোষারোপ করে লাভ নেই, এটা খুব পুরনো অভিযোগ। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এখন যাঁদের লেখা, যাঁদের জীবনচর্যা আমাদের প্রাণিত করে তাঁরা অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ভালো করে বাংলা শিখতে, লিখতে, বলতে ইংরেজি কখনও তাঁদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লেখকদের কথা ছেড়ে দিলেও দেখা যাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী মানুষজনও তখন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় ভাবতেন, বাংলা নিয়ে ভাবতেন, বাংলায় লিখতেন। যেমন ধরা যাক, স্বামী বিবেকানন্দের কথা। মোটেই লেখক নন; সন্ন্যাসী, ধর্মপ্রচারক, বাগ্মী; জীবনের জরুরি লেখালেখি কাজকর্ম ইংরেজিতেই করেছেন; কিন্তু তিনিও যখন বাংলা লিখেছেন সেটা একটা যুগান্তকারী ভাষাভাবনার দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যায়! জগদীশচন্দ্র বসুর কথাই ধরা যাক। আজীবন বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন বিষয় ইংরেজিতেই বলেছেন, লিখেছেন; কিন্তু তিনি যখন 'অব্যক্ত' লেখেন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় সেটা একটা চিরায়ত সৃষ্টি হিসেবে থেকে যায়! মূলত রাজনীতির জগতের মানুষ চিত্তরঞ্জন দাশ বা সুভাষচন্দ্র বসুও ইংরেজি-হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সমান গুরুত্ব দেন, সেই ভাষাতেও জরুরি জিনিসপত্র লেখেন।


এই উদাহরণগুলি বিচ্ছিন্ন নয়। বরং প্রতিনিধিত্বমূলক। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায়, অতীতের দ্বিভাষিক বঙ্গজন বাংলা ভাষার প্রতি যে মনোভাব পোষণ করতেন, সেটাই আমরা একালের মানুষ হারিয়ে ফেলছি। আর তাই ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা দিন-দিন কমছে। অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনে আমাদের কাজ-কর্ম, চলা-বলা বা ভাবা-লেখা ইত্যাদিতে আমাদের 'স্ব-ভাব' নিত্য-নিয়ত যেভাবে ব্যক্ত হচ্ছে তাতে ভাষার সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। ভাষাটা বহুলাংশে মনুষ্যস্বভাবের অংশ বলেই একালে ভাষা প্রতিদিনই একটু-একটু করে খঞ্জ হয়ে পড়ছে। তার প্রকৃত বিকাশ প্রায় বন্ধই।


ফলে, শামসুর রহমানের 'বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে' কবিতাটি আজ হয়তো আমাদের বিস্মিতই করে। আমরা ভেবে পাই না, সত্যিই কি বাংলাভাষা, মাতৃভাষা, স্বভাষা এত অভিঘাতময়? শামসুর লিখেছিলেন-- 'বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে/ রোদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা/ উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে/ উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর/ বাঁকে বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়। যখন সকালে/ নতুন শিক্ষার্থী লেখে তার বাল্যশিক্ষার অক্ষর,/ কাননে কুসুমকলি ফোটে।' (অসম্পূর্ণ)


কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে ছিল-- 'বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে কত/ চেনা ছবি মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন/ ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া কোন্‌ সে সুদূরে; সত্তা তাঁর/ আশাবরী।' (অসম্পূর্ণ)


বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে আর কি সেভাবে ছবি ভেসে ওঠে আমাদের চোখে? মায়ের অন্তর্লীন সত্তার আশাবরীর স্পন্দন কি আজ আর প্রাণিত করে আমাদের? নতুন শিক্ষার্থী যখন বাংলায় তার প্রথম অক্ষরটি লেখে তখন কাননে কি ফুটে ওঠে ফুল? বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে কি নদী নর্তকী হয়ে ওঠে, উদার গৈরিক মাঠে বেজে ওঠে অন্ধ বাউলের মুখর একতারা? বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে কি আজ আর নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ?


রোদ তো অবিরল; রোদ না হয় ঝরল, কিন্তু উঠোন তো নিকিয়ে রাখতে হবে। আসুন, এই পয়লা বৈশাখে আমরা উঠোন নিকিয়ে রাখার কাজটা অন্তত শুরু করি। আজ আমরা যদি প্রিয়জন-পরিজন-বন্ধুজনকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা হোয়াটসঅ্যাপে 'ইমোজি' না পাঠিয়ে একটু আন্তরিক অক্ষরচর্চা করি, মন্দ হয় কি? অন্তত আজ যদি একটু বাংলা পড়ি, বাংলা শুনি, বাংলা লিখি, তা হলেও হয়তো সন্ধের বারান্দায় লেগে থাকতে দেখতে পারি জ্যোৎস্নার অপূর্ব চন্দন!


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)