সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে বঙ্কিমচন্দ্রকে চট্টোপাধ্যায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি একটি দারুণ দিকদর্শী কথা লিখেছিলেন-- 'বাঙ্গালি সমাজ শাস্ত্রের বশীভূত নহে-- দেশাচার বা লোকাচারের বশীভূত।' 


বাঙালির পয়লা বৈশাখের উদযাপন দেখলে এটা যেন আরও বেশি করে মনে হয়। কেননা, এর সঙ্গে কোনও ধর্মীয় যোগাযোগ নেই। অথচ কালে-কালে তা কীরকম প্রাণিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল!


নববর্ষের পত্তন নিয়ে অবশ্য বহু তত্ত্ব। কেউ বলেন এটা আকবরের সৃষ্টি, কেউ বলেন শশাঙ্কের। বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মোগল সম্রাটের নামই যদিও বেশি শোনা যায়। তবে অনেকের মতে, বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবক সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কই। পরবর্তী কালে সম্রাট আকবর সেটিকে খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেন। আকবরের সময় প্রচলিত ক্যালেন্ডারের নাম ছিল তারিখ-ই-ইলাহি। 


ভারতে মোগল শাসনকালে হিজরি পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। এই পঞ্জিকা চাঁদ-নির্ভর। এর ভিত্তিতেই কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করা হত। কিন্তু চাঁদনির্ভর হিজরি সন বাংলার কৃষিজাত ফলনের সঙ্গে মিলত না। ফলে অসময়ে খাজনা দিতে সমস্যায় পড়তেন কৃষকরা। এই সমস্যা দূর করার লক্ষ্যেই বর্ষপঞ্জি সংস্কার আকবরের। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সম্রাটের আদেশে সৌর সন ও হিজরি সনের ভিত্তিতে একটি মিশ্র বাংলা সন তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সনের গণনা শুরু করা হয়। তবে খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। আগে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল 'ফসলি সন'। পরে তা 'বঙ্গাব্দে' বদলে যায়। তখন চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে খাজনা দিতে হত কৃষকদের। এর পরের দিন, পয়লা বৈশাখে জমির মালিকেরা নিজের এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন। হত উৎসবও।


আরও একটু ইতিহাস ঘাঁটা যাক। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে বরাহমিহির ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেছিলেন 'পঞ্চসিদ্ধান্তিকা'। সেই গ্রন্থটিতে 'সূর্যসিদ্ধান্ত'-এর ধারণা এল। সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে, বিশাখা নক্ষত্র অনুসারে বৈশাখই বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। আর সেই মাসের প্রথমদিনটিই নববর্ষের দিন।


কিন্তু এ তো হল তারিখ সংস্কারের তত্ত্ব। সেই চন্দ্র-সূর্য ছানবিন করা তত্ত্ব কবে মিশল জীবনের সঙ্গে?


তারও একটা তথ্য পাওয়া যায় বইকী! কবি ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নাকি এক নববর্ষের দিন অতিথি আপ্যায়ন করে খাওয়াদাওয়ার দারুণ আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ের শহর কলকাতার হু'জ হু'রা উপস্থিত ছিলেন সেই মজলিশে। শোনা যায়, ছিলেন এমনকী দেবেন ঠাকুরও। মোটামুটি এরপর থেকেই নিয়ম করে নববর্ষের দিন পালিত হয়ে আসছে বলে মত আমাদের সাংস্কৃতিক গবেষকদের একাংশের।


যে ভাবেই শুরু হোক আর যাঁর হাতেই শুরু হোক, ক্রমে নববর্ষ এবং তার উদযাপন কিন্তু বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে পড়ল। নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তার নানা অভিমুখ তৈরি হয়ে গেল। বইব্যবসায়ীদের মধ্যে একরকম; বিশেষত প্রকাশকদের মধ্যে। সেখানে কলেজ স্ট্রিট নববর্ষের একটা অন্যরকম ঐতিহ্য তুলে ধরল। অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবার হালখাতাকে কেন্দ্র করে মিষ্টির বাক্স-ক্যালেন্ডারের একটা নববর্ষ তৈরি হয়ে উঠল। আর আমবাঙালির নববর্ষ মানে ওই একটা দিন একটু বেশি-বেশি করে বাঙালিয়ানার আঁচ পুইয়ে নেওয়া। সনাতনী বাঙালি ব্যঞ্জন, পুরনো বাংলা গান, শাড়ি-ধুতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বেঁচে-বর্তে রইল সেই ব্যক্তিগত কিন্তু সামাজিক উদযাপন।


শোনা যায়, হালখাতার ঐতিহ্যও বেহাল হয়ে পড়েছে আজকাল। তবু এই সেদিন পর্যন্ত কিন্তু ১ বৈশাখের দিনে মন্দিরে-মন্দিরে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হালখাতার উজ্জীবিত চেহারাটা দেখা যেত। ভোরে স্নান সেরে নতুন জামা-কাপড় পরে পুজোর ডালা নিয়ে মন্দিরে যাওয়া। সঙ্গে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি, হলুদ-সিঁদুর মাখা মুদ্রা বা ষোলো আনা। মুদ্রাটিকে দেবীঅঙ্গে স্পর্শ ও পুজো করিয়ে দেবীরই স্পর্শপূত সিঁদুরে মাখিয়ে মুদ্রাটির ছাপ দেওয়া হয় লালশালু বাঁধানো নতুন হিসাবের খাতায়। এই খাতাটিই নতুন বছরের আয়-সমৃদ্ধির সূচক (অনেক ব্যবসায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনও এই অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকেন)।


এখন সব কিছুতেই অনেক পরিবর্তন এলেও তবুও নববর্ষ এখনও যেন আক্ষরিক অর্থেই নতুন। হালখাতা, নতুন বাংলা পঞ্জিকা, মিষ্টি, নতুন পোশাক-- সবকিছুর নতুন গন্ধটা এখনও ফিরে-ফিরে পাওয়া যায়। ঐতিহ্য পরম্পরার অবশেষ বোধ হয় আজও বাঙালির সঙ্গে কিছুটা রয়ে গিয়েছে।


কিন্তু নববর্ষ মানে কি শুধু বাহ্য আচরণ, উপচার, উদযাপন, উৎসব? না, তা নয়। নববর্ষ একই সঙ্গে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির ধারক-বাহকও। আমাদের রুচি-মেজাজের পরিচায়কও। সেইখানটায় এসে কিন্তু আমরা ইদানীং ঘা খেয়ে যাচ্ছি।


এখন এই ভোটবাংলায় যেন প্রতিদিনই ধ্বস্ত হচ্ছে আমাদের সাধের ভাষা-সংস্কৃতি। একটা অ-বাঙালিপনার রমরমা, উচ্চকিত হিন্দিপনা সুচারু ভাবে গ্রাস করছে আমাদের একান্ত নিবিড় মিঠে বাঙালিয়ানাকে। তাতে প্রতিটি ধাপে রুচির অবনমনের ছাপ। আজকাল শিক্ষাতেও এসেছে এক সুঘোষিত সর্বভারতীয়ত্বের ছাপ। তার খাতিরেও অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিত্ব, বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম। শ্রীচৈতন্য, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম
যে বাঙালিয়ানা, যে বঙ্গসংস্কৃতি, যে বঙ্গজ রুচি ও মেজাজের নির্মাতা এবং ধারক-বাহক, তা আমরা ক্রমে হারাতে বসেছি। যে ভাষাকে আজ আমরা এত অবহেলার মধ্যে রেখেছি সেই ভাষাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য। 


চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ শ্রীধর কলাগাছের খোলা বেচে খান। সেই শ্রীধরকে চৈতন্যদেব নবদ্বীপে এক ভাবাবেশের মধ্যে বললেন, 'শ্রীধর আমার স্তব করো।' শ্রীধর বললেন, 'আমি সংস্কৃত জানি না। কী স্তুতি করব?' তখন আসলে স্তবস্তূতিশ্লোকের ক্ষেত্রে সংস্কৃতেরই ব্য়বহার সিদ্ধ, বাংলা ব্রাত্য। শ্রীধরের সমস্যাটা উপলব্ধি করে চৈতন্য তাঁকে বললেন-- 'তুমি যা বলবে তা-ই আমার স্তুতি, তুমি বাংলাতেই বলো।'


তখনকার দিনে এটা বিপ্লব। রঘুনাথ শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-- এঁরা কেউই সে সময়ে বাংলা ভাষার এই গুরুত্বটা ঠিক এভাবে উপলব্ধি করেননি বা সমাজের নিচের স্তর পর্যন্ত সেই উপলব্ধিটা পৌঁছে দিতে পারেননি।


কিন্তু আবহমান যে বাঙালি কালচারের কথা বলা হচ্ছে, সেই কালচারের আবার অন্য একটা মুখও জানা যায়। 'পঞ্চতন্ত্র' রচনায় স্বয়ং মুজতবা আলী বলছেন, ভূত, অভূত, নাৎসি, কমিউনিস্ট, মিশনারি কলাবৎ সম্পাদক দারোয়ান ছাড়াও আর একটি জিনিসই তিনি ভয় পান, সেটি হল 'কলচর'; মুজতবা বলছেন-- ''বাংলাদেশে 'কলচর' আছে কিনা জানিনে, যদি-বা থাকে, তবে আমি তা এড়িয়ে যাওয়ার অন্ধি-সন্ধি জানি।'' অভিমান থেকে বলেছেন কি? হতেও পারে।


তা হলে নববর্ষের আবহে আমাদের বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি, বাঙালিয়ানা, কলচার সবটা যেন কেমন ঘেঁটে 'ঘ' হয়ে গেল। ঠিক যেমনটা কবি রঞ্জিত সিংহ তাঁর 'মুখোশ' কবিতায় লিখেছিলেন-- 'মুখোশের চাপে মুখ ভেঙে ভেঙে গুঁড়ো কাচ'! বাঙালিয়ানা আমাদের মুখ না মুখোশ? সেটা প্রমাণ করাই কিন্তু নতুন বাঙালির দায়িত্ব। এই নববর্ষে বরং সবার আগে সেই সঙ্কল্পই আমরা নিই।