রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ১২৫: `গঙ্গোত্রী` ছাড়িয়ে নিরন্তর বইছে রামকৃষ্ণ-ভাবগঙ্গার অনন্ত আনন্দধারা
তবে ১ মে তারিখটাকে খানিকটা প্রতীকীও ধরা যেতে পারে। আরও কত দিনের ইতিহাস ও কর্মভাবনা যে একে পরিপুষ্ট করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। ১ মে-র পরেও অনেক আবর্তন, অনেক বিবর্তন, অনেক ঠাঁইবদল, অনেক পরিবর্তন, অনেক পটবদল। সে সবেরই ইতিহাস রক্ষিত।
সৌমিত্র সেন
শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে নরেন্দ্রনাথ-রাখাল-তারক প্রমুখ ঠাকুরের প্রধান ও সাক্ষাৎ শিষ্যেরা সাধনভজন ও তীর্থদর্শন অভিলাষে ভারতের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। ছড়িয়ে না-হয় পড়লেন, কিন্তু যদি কখনও সকলে মিলে একজোট হয়ে সাধনভজনে মাততে চান, কোথায় উঠবেন তাঁরা? এ নিয়ে রামকৃষ্ণ-সহধর্মিণী তথা সারদামণি-- যাঁকে পরবর্তীকালে 'সঙ্ঘজননী' আখ্যাও দেওয়া হবে-- নিরন্তর মনোকষ্টে ছিলেন। তিনি ঠাকুরের কাছে এ নিয়ে করুণ গভীর প্রার্থনাও জানাতেন; বলতেন, তাঁর সন্তানরা কি এভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াবেন, এ জন্যই কি তাঁর (ঠাকুরের) আসা? ছেলেরা কি তাঁদের গুরুর নামে এক ছাদের তলায় একজোট হতে পারবে না?
একইরকম মনোবাসনা ছিল নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দের। অনেক পরে তিনি যখন শিকোগোয় বিশ্বজয় সেরে ফেলেছেন, তখনও তাঁর মনের গভীরে এই ইচ্ছা আরও বেশি করে যেন দানা বাঁধছিল। ঠাকুরের নামে একটা জমি কিনে সেখানে ঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সর্বমানবের কল্যাণসাধনের লক্ষ্যে পাকাপাকি এক প্রতিষ্ঠান তৈরি তাঁর স্বপ্ন ছিল; না হওয়ায় মনোকষ্টও ছিল। তবে ছিল তীব্র জেদ ও সঙ্কল্প।
বিশ্ববিখ্যাত বিবেকানন্দের দেশি ও বিদেশি ভক্তগণের মধ্যে বেশ কাছের যাঁরা, তাঁরা স্বামীজির এই লক্ষ্য এবং তা সম্পাদিত না হওয়ার মনোকষ্টের খবর রাখতেন। সকলেই সকলের মতো চেষ্টা করতেও চাইতেন। কিন্তু টাকা এবং টাকা ছাড়া আরও নানা সমস্যা উদ্ভূত হত। ফলে বিষয়টায় ক্রমশ দেরি হয়ে যাচ্ছিল।
তবে অস্থায়ী মঠ তো প্রথম থেকেই ছিলই; বরানগর, আলমবাজার, কাশীপুর (আংশিক ভাবে), বেলুড়ে গঙ্গাতীরস্থ নীলাম্বরবাবুর বাড়ি (আংশিক ভাবে)-- গুরুভাইদের জন্য নানা সময়ে নানা সঙ্ঘবদ্ধতা বা সঙ্ঘজননীর অস্থায়ী আশ্রয় তো ছিলই। কিন্তু একেবারে খাঁটি অর্থে নিজের ঠাঁই তো ছিল না। অনাগত দিনে যাঁরা ঠাকুরের নামে ঘর ছাড়বেন, তাঁরা কোথায় এসে উঠবেন?
ফলত, নানা সময়ে নানা চেষ্টাচরিত্র হয়েছে। সব চেয়ে বেশি চর্চা হয়েছিল কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যান নিয়ে। কিন্তু সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত রামচন্দ্র দত্তের প্রতাপ। বিশুদ্ধ অর্থে সাধুসন্ন্যাসীদের জন্য একটি ঠাঁইয়ের তাই প্রয়োজন ছিলই। আর তার জন্য রামচন্দ্রের মনে কষ্ট না দিয়েই নীরবে নিভৃতে ঠাকুরের নামাঙ্কিত মঠ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সন্ন্যাসীদের তরফে জারি ছিল।
এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৯৭ সালের ১ মে কলকাতার বাগবাজারস্থিত বলরাম বসুর বসতবাটী, যেটি পরবর্তী কালে 'বলরামমন্দির' হিসেবে সমধিক খ্যাত, সেখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। বাড়িটির এখন যে-হলে ঠাকুরের পুজো হয়, অর্থাৎ মন্দির এবং তারই সঙ্গে সংলগ্ন প্রার্থনা-গান-ধ্যান-সভার জন্য নির্দিষ্ট অংশ, সেই লম্বা হলঘরে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে, মঠ মিশনের যে কোনও স্মরণীয় দিনের সঙ্গেই চিরকাল গাঁথা থাকবে বলরাম বসুর ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেবে হয়তো যে, আজ বিশ্বময় বিপুল গৌরবে ছড়িয়ে পড়া বিপুলকায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংক্ষিপ্ত শুরুটা সেদিন ঘটেছিল একেবারে খাস উত্তর কলকাতায়, কলকাতার ছেলে বিবেকানন্দের জন্মস্থানের সামান্যই দূরে।
তবে ১ মে তারিখটাকে খানিকটা প্রতীকীও ধরা যেতে পারে। আরও কত দিনের ইতিহাস ও কর্মভাবনা যে একে পরিপুষ্ট করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। ১ মে-র পরেও অনেক আবর্তন, অনেক বিবর্তন, অনেক ঠাঁইবদল, অনেক পরিবর্তন, অনেক পটবদল। সে সবেরই ইতিহাস রক্ষিত। আর সেই ইতিহাসের সালতামামি থেকেই খুঁজে দেখা যায় তাৎপর্যময় কিছু ঘটনাপ্রবাহের। যেমন, ১৮৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। স্বামীজি সেদিন সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ''আপনারা আজ কায়মনোবাক্যে ঠাকুরের পাদপদ্মে প্রার্থনা করুন যেন মহাযুগাবতার ঠাকুর আজ থেকে বহুকাল 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়' এই পুণ্যক্ষেত্রে অবস্থান করে একে সর্বধর্মের অপূর্ব সমন্বয়কেন্দ্র করে রাখেন।'' এ প্রার্থনা, বলাই বাহুল্য, শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাকল্পেই।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম বিশিষ্ট গবেষক ও সুলেখক স্বামী প্রভানন্দের 'রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা' গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারছি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটির ঘটনা। ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর। এর আগের দিন অর্থাৎ, ৮ ডিসেম্বর স্বামীজি কলকাতা থেকে বেলুড় মঠে এসে রাত্রিবাস করেছিলেন। ব্রক্ষচারী হরিপদ (যিনি পরে স্বামী বোধানন্দ) কলকাতায় গিয়ে ঠাকুরের পুজোর জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনে এনেছিলেন। আর ঘটনার দিন, মানে ৯ ডিসেম্বর সকালে কলকাতা থেকে মঠে এসে পৌঁছেছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী সদানন্দ, স্বামী বিরজানন্দ। ছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, মিস বুল, মিস ম্যাকলাউড, ভগিনী নিবেদিতা। সেদিনের ঘটনাবিষয়ে মঠের ডায়েরিতে লেখা-- 'Thakur was taken to the new math and the new math was consecrated'!
আদতে কী হয়েছিল?
ওইদিনই ঠাকুরের পুণ্যভস্মচূর্ণ, যেটি 'আত্মারামের কৌটো' হিসেবে খ্যাত--যাকে ঘনিষ্ঠ রামকৃষ্ণ ভক্তশিষ্য 'শ্রীজি' বলেও উল্লেখ করেন-- সেটিকে নতুন ঠাকুরবাড়িতে এনে ষোড়োশোপচারে শ্রীশ্রীঠাকুরের পূজো ও হোম করা হয়েছিল। হয়েছিল অন্নভোগ। বিকেলে স্বামীজি কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এতদিন ধরে এক কষ্ট করে এত তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে যে মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠা হল, সে কি কেবল ভারতের সহস্র সহস্র মঠ-মিশনের ভিড়ে আর একটি কেবল? না, একেবারেই নয়। স্বামীজি প্রথম থেকেই এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন-- 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ'। নিজের মুক্তি এবং জগতের কল্যাণসাধন। আশ্চর্য খাপছাড়া এই মন্ত্র-বলে আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এক অনন্য অটল সঙ্ঘ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে। ১২৫টি বছর তার পক্ষে হয়তো সামান্যই!
স্বামী প্রভানন্দ তাঁর ওই বইতেই এ বিষয়ে সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। লিখেছিলেন -- ''বলা যেতে পারে, দক্ষিণেশ্বর যদি হয় রামকৃষ্ণভাবধারার 'গোমুখ', বেলুড়মঠ সে ভাবধারার 'গঙ্গোত্রী'''! এই 'গোমুখ' থেকে নিরন্তর আনন্দধারার মতো নির্গত রামকৃষ্ণভাবধারা আরও কতদিন ধরে বয়ে যাবে 'গঙ্গোত্রী'র পানে এবং গঙ্গোত্রী ছাড়িয়ে আরও দূর তৃষিত জনপদের দিকে, ছড়িয়ে দেবে তার অমেয় অমৃত, তা তে জানে!