সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

দাদাঠাকুর লিখেছিলেন, আমাদের নিত্য রাশ, নিত্য  ঝুলন! এই 'রাশ' বোঝাই যাচ্ছে, 'দৌড়' অর্থে; আর 'ঝুলন' বাসে-ট্রেনে-ট্রামে ঝুলতে-ঝুলতে যাওয়া। বাঙালিজীবনের নানা অভ্যাস নিয়ে দাদাঠাকুরের সরস মন্তব্য আছে। বাঙালির রাসপূর্ণিমা এবং ঝুলনকে 'মিন' করে তাঁর এই মন্তব্যও বেশ মজাদার। তাই রাস-উৎসবের তিথি এলেই দাদাঠাকুরের কথাটি মনে পড়ে যায়।


আজ, রবিবার রাস। তবে এ বারের তিথি এমন পড়েছে যে, রাস কালকেও কোথাও কোথাও পালিত হবে।  কার্তিকী পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত রাস-উৎসব বঙ্গজীবনের অন্যতম ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উদযাপন। এর দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। 


রাস শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অংশবিশেষ। বৃন্দাবনে শ্রীরাধা-সহ অন্য গোপীদের সঙ্গে এই লীলা করেছিলেন তিনি। 'রাস' মানে, পরস্পর হাত ধরে মণ্ডলাকারে নৃত্য। রাস মূলত পাঁচরকম: মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস, নিত্যরাস। রাসের অনেকগুলি পর্যায়ও আছে: গোপিনীদের কৃষ্ণ-অভিসার, কৃষ্ণের বংশীবাদন, গোপিনীদের নৃত্যগীত, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান এবং প্রত্যাবর্তন। বলা হয়, 'রস' থেকেই 'রাস' শব্দটি এসেছে। 'রস' অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, অমৃত ও ব্রহ্ম। তবে বৈষ্ণবদর্শনে 'রস' বলতে মূলত মধুর রসই বোঝায়। 


বঙ্গজীবনে রাস নতুন করে উদ্দীপনা এনে দেয় দু'জন মানুষের সৌজন্যে। শ্রীচৈতন্যদেব ও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপে রাস-উৎসবকে দারুণ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। কৃষ্ণসাধনা, রাধা-কৃষ্ণের সম্মিলিত রাস উদযাপন, সঙ্গে সহযোগী পদাবলিগান মিলিয়ে-মিশিয়ে শ্রীচৈতন্য ও তাঁর অনুগামীগণ রাসকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনার অন্যতম একটা অঙ্গই করে তুলেছিলেন। তবে শ্রীচৈতন্য নীলাচলে চলে গেলে এবং পরে তাঁর তিরোধান ঘটলে নবদ্বীপের রাস-মহিমা ধীরে ধীরে অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়। 


এর প্রায় দু'শো বছর বাদে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আবার নতুন করে রাসকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মোটামুটি ধরা হয়, ১৭৫৩-৫৬ এই সময়-পর্বেই তিনি রাস প্রবর্তন করেন। 


তবে শ্রীচৈতন্যের রাস ও কৃষ্ণচন্দ্রে রাসের মধ্যে মূলগত ফারাক ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শাক্ত। তিনি চাইতেন, তাঁর রাজত্বে শক্তিসাধনাই যথেষ্ট জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হোক। যদিও বৈষ্ণবদের প্রতি তিনি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন না, তবে এ কথাও ঠিক, তিনি শ্রীচৈতন্য ও তাঁর অনুগামীদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। আসলে চৈতন্য অনুগামীরা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মেনে চলতেন। শাক্ত কৃষ্ণচন্দ্রের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন হত। তাই রাস প্রবর্তন করলেও তিনি ব্যাপারটা একটু বদলে নিলেন। তাঁর প্রবর্তিত রাস ক্রমে 'শাক্তরাস' হিসেবে পরিচিত হল। 


আসলে এই দিনটিতে বহু বছর ধরেই নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা তাঁদের গৃহে অধিষ্ঠিত দেবীর পূজা করতেন। বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজোর সেই ধর্মীয় আচারটিকে কৃষ্ণচন্দ্র রাসের সঙ্গে জুড়ে নিলেন। বড় বড় আকারের দেবীমূর্তি বানিয়ে এখানে তখন থেকেই রাস উদযাপন হতে শুরু হয়। যা আজও চলছে।


'রাস' নিয়ে আধুনিক সময়েও কম বিতর্ক হয়নি। 'কৃষ্ণচরিত্র'-এর মতো গ্রন্থের লেখক স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র রাসকে স্বীকার করেননি। তিনি বলেছিলেন, রাস হল কামের উৎসব, কামের উদযাপন, তা কৃষ্ণে শোভা পায় না। বঙ্কিম রাধাকেও মানেননি। এ নিয়ে কম চাপানউতোর হয়নি। বঙ্কিম রাসলীলাকে নস্যাৎ করে দিলেও এক দল বৈষ্ণব-দার্শনিক সম্পূর্ণ অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করেন এটিকে। তাঁরা বলেন, গোপীদের হৃদয় ছিল কামকামনাহীন, রাসলীলা তাই কামগন্ধহীন প্রেমসাধনেরই উদযাপন। বৈষ্ণব-তাত্ত্বিকেরা এ ক্ষেত্রে হাজিরও করছেন এক যুক্তি। তাঁরা হিসেবনিকেশ করে দেখিয়েছেন, রাসলীলার সময়ে কৃষ্ণের বয়স সাত বছর দু'মাস! এই বয়সে আবার কামের উদযাপন কী! এই বয়স-তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কেননা, ভাগবতপাঠক মাত্রেই জানেন, কংসের ডাকে কৃষ্ণ যখন মথুরাগমন করলেন তখনই তাঁর বয়স মাত্র তেরো!


অবশ্য বিশ্বাসীর কাছে বয়স-যুক্তির কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই, গুরুত্বও নেই। আবার অবিশ্বাসীরও মেনে নেওয়ার কোনও দায় নেই। তবে, আজ আর রাসকে ঘিরে ধর্ম-দর্শন, যুক্তি-অযুক্তির এত তূল্যমূল্য বিচার-সংঘাত নেই। আজ রাস সম্পূর্ণ ভাবে একটি বর্ণিল উৎসবে পরিণত হয়েছে। সমস্ত বিশ্বাসের মানুষ সেখানে নিজেদের বিশ্বাস অটুট রেখেই উদযাপনে অংশ নেন। দেখতে গেলে আধুনিক সময়ে রাসের স্পেকট্রাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। তা আক্ষরিক অর্থেই উৎসব। নদিয়া থেকে নন্দীগ্রামে তার বিস্তার। আনন্দ ও রসই তারই উপজীব্য।


আরও পড়ুন:  'স্বাস্থ্য আগে, শাস্ত্র পরে' এই মন্ত্র নিয়েই 'নবান্নে'র দিনে সর্বমঙ্গলা মন্দিরে শুরু ভোগবিলি