`তিন তালাক` ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্ট, বিজেপি, আরএসএস`কে এক তিরে বিঁধলেন রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী
ভারতের শীর্ষ আদালতের রায়ে ৬ মাস পর্যন্ত স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে ১৪০০ বছরের প্রাচীন লোকাচারে। 'তিন তালাক' নিয়ে ঐতিহাসিক রায়ে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, 'তালাক অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং পাপ'। আর এই নিয়েই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তর্জা। রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরীর দাবি, তালাককে নিষিদ্ধ করা মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সমান। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে বিজেপি এবং আরএসএস'কে এক তিরে বিঁধলেনও রাজ্যের গ্রন্থাগার বিষয়ক মন্ত্রী। তালাক ইস্যু নিয়ে অকপট সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী। মন্ত্রীর একান্ত সাক্ষাৎকার নিল ২৪ ঘণ্টা ডট কম।
তালাক ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, 'তালাক অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং পাপ'। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি খেহর, ৩৯০ পাতার রায়ের মধ্যে ২১০ পাতার রায় তাঁর দেওয়া। আর বাকি ১৮০ পাতা বাকি চার বিচারকের। তার মানে প্রকৃত পক্ষে 'পার্সোনাল ল', ভারতের সংবিধান এবং এই ১৪০০ বছরের প্রাচীন 'তালাক প্রথা', একমাত্র তিনিই বুঝেছেন (বিচারপতি জে এস খেহর)। বাকিরা বোঝার চেষ্টা কতটা করেছেন আমার জানা নেই। জাস্টিস খেহর অকপটে স্বীকার করেছেন যে হানাফি, সুন্নি, মুসলমানদের মধ্যে শরিয়ত সম্মত তালাক প্রথাটা একেবারে তারা মন দিয়ে ধরে রেখেছেন, এটা তাদের ধর্মের বিশ্বাস, তাদের বাস্তব, তাদের আচরণ। এক্ষেত্রে ভারতের সংবিধান 'মৌলিক অধিকারে'র ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কোর্টের সেই অধিকার নেই। এরপরও কী তালাক-কে 'অসাংবিধানিক' বলার জায়গা থাকে?
কিন্তু...
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- আমি বলি...। বিজেপি সরকার যে হলফনামা দাখিল করেছিল, তাদের বক্তব্য ছিল তিন তালাক উঠিয়ে দাও। তাহলে যা দাঁড়াল, বিজেপির যে প্রস্তাব সেটা ছিল একেবারে সংবিধান বিরোধী। মিস্টার খেহর এবিষয়েও দুঃখ প্রকাশ করেছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে কার্যকরী করার জন্য এবার একটা প্রবল চাপ শুরু হয়ে গেল। আমাদের তো আলাদা করে কিছুই বলার নেই, যা বলার বিচারপতিই বলে দিয়েছেন। আমরা বলছি কারণ, এদেশ আমরা গড়েছি। আরএসএস ব্রিটিশদের দালালি করেছে। আমার রেকর্ডে নেই, আরএসএসপন্থী নেতারা ব্রিটিশের জেলে গেছেন। শহিদ হয়েছেন ১৫ লক্ষ্য মানুষ, একজনও আরএসএসের নেই। এই হিন্দুত্ববাদী জাগরণ সমিতির একজনও শহিদ হননি। আজ তারা ভারতবর্ষের চিরাচরিত, সর্বজন সম্মত, লোকসভায় গৃহীত সংবিধানকে ভাঙার চেষ্টা করছে। দেশকে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা করছে, দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লাগাবার চেষ্টা করছে। 'মুসলিম বনাম মুসলিম', একটা বিবাদ তৈরির চেষ্টা করছে।
তালাক ইস্যুতে তো আরএসএস কোর্টের কাছে যায়নি। প্রতিবাদটা এসেছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের থেকেই। শায়রা বানো, ইশরত জাহান, আফরিন রহমান, গুলশন পারভিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। খুরান সুন্নত সোসাইটি, মুসলিম উইম্যান কোয়েস্ট ফর ইকুয়ালিটি'র মত সংঠনগুলোও তালাক প্রথার বিরুদ্ধে। কী বলবেন আপনি?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- ইশরত জাহান নিয়ে বললে সে ছোট হয়ে যাবে, তবুও আমি বলছি। ইশহরত জাহানের প্রবল স্বাধীনচেতা মনোভাব স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ার কারণ। সে তাঁর স্বামীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। এই চরিত্রের মহিলা কি স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে পারে, না স্বামী তাঁর সঙ্গে থাকতে পারে? এ কেমন মহিলা যে নিজের স্বামীকে মেসেজ করে, তোমার তিন মাসের জেল হবে। কোনও বাবা আটকাতে পারবে না। তুমি আরেকটা বিয়ে করেছ, তোমার সন্তান আর বউ কীভাবে থাকে, সেটাও দেখে নেব আমি। আমি ইশরত জাহান। এই দিকটা সংবাদ মাধ্যমের বন্ধুরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার প্রশ্ন, কে তাকে সাহায্য করছে, যে এত বড় খবরদারি সে করছেন? এখন ইশরত যে বাড়িতে থাকেন সেটাও তো দুবাইয়ে থাকা স্বামীর বাড়ি। যে পাতে খাব সেটাই ছিদ্র করব? সে তো পরিত্যক্তা, তাকে তো তাড়িয়ে দিতে পারত, তার স্বামী সেটা করেনি। এই মহিলা মাঝে মধ্যেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত।
আপনি তো ব্যক্তি আক্রমণ করছেন!
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- না, আমি বলি... এভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। স্বামীর অন্তর দগ্ধ করে দিয়েছে, এটা কেউ দেখতে পায় না। এবার প্রশ্ন হল তালাক দেওয়ার পর ভবিষ্যৎ কী?
বনিবনা হচ্ছে না, মানসিক অবসাদের কারণে বিচ্ছেদ। এটা মৌখিক না হয়ে কোর্ট রুমে হলে অসুবিধা কোথায়?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- আদালতের সমস্যা হল, সারা ভারতে এখন এক কোটির ওপর মামলা ঝুলছে। পর্যাপ্ত বিচারক না থাকার কারণে এই পেন্ডিং মামলা মেটাতে তিনশো বছর লেগে যাবে। কলকাতা হাইকোর্টে এমন অনেক ডিভোর্সের মামলা আছে যা নিষ্পত্তি হতে চোদ্দো বছর লেগে গিয়েছে। এভাবে ইশরত জাহান যদি ঝুলে থাকে, কে তাঁকে দেখবে?
তাহলে কী ইসলাম ধর্মাবলম্বী পুরুষরা সেই অধিকার পাবেন যেখানে তারা নিজেরাই বিচারক হয়ে বিচার করবে?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- বিচারের দুটি দিক। তারমধ্যে একটা হল ফৌজদারি। ভারতের ফৌজদারি বিধি সবার জন্য সমান। এটা হল পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার। ইসলাম ধর্মে ওই ভাবে তালাকের (কোর্ট রুমে নিষ্পত্তি) পদ্ধতি নেই। পবিত্র কোরানে যেটা আছে- বনিবনা হচ্ছে না, নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝি কর। সেটাতে না মিটলে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি কর। একই ঘরে দুটো বিছানা আলাদা কর। দূরত্ব হলে স্বামী অনুতপ্ত হবে, বউ অনুতপ্ত হবে, দূরত্ব দূর হলে সম্পর্ক থেকে গেল। এতেও যদি না হয় তো তাকে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠাও। একটু ঘুরে আসুক। বোঝাপড়া করে আসুক। এরপরও সমস্যা না মিটলে তাকে মৃদু শাসন কর। তার মানে কিন্তু কখনই ঠ্যাঙানো না। সে যেন বোঝে স্বামী 'নারাজ'। তাতেও না হলে পিতৃকুলের আত্মীয়দের সঙ্গে দুই পক্ষই বসুক, একটা সমঝোতার রাস্তা আনা হোক। 'তালাক তালাক তালাক' না হয়ে অচলাবস্থার সমাধান বার করা হোক। এতেও না মিটলে, এক তালাক দাও। কিন্তু মেয়ে গর্ভবতী অবস্থায় থাকে তাহলে তালাক দিও না। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মেয়েটা যাবে কোথায়? এক তালাকের পরেও ফিরে আসার কথা শরিয়ত-এ আছে। এতেও না হলে স্ত্রী যখন 'পাক সাফ' থাকবে তখন তাকে তালাক দাও। এতেও না মিটলে তিন তালাক দাও। এটাই বিশুদ্ধ তালাক পদ্ধতি। এই মতে তালাক দিলে আল্লহর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। স্বামী বুঝতে পারল বউ বিপথগামী হচ্ছে, নৈতিক দুর্বলতার শিকার। কারোর মাথার ঠিক নেই, আগুনে ঝাপ দেওয়ার মত অবস্থা... ইসলাম তার থেকে বাঁচার জন্যও পথ বলে দিয়েছে। এই জটিলতাকে সমাধান করার জন্য রাস্তা আছে ইসলামে। নিয়ম নীতি ভাঙার ক্ষমতা আমাদের নেই।
কেন্দ্র সরকারকে প্রস্তাব:
সরকার চাইলে সালিশি কমিটি করতে পারে। মনিটরিং কমিটি করতে পারে। আমরা পূর্ণ সাহায্য করব। সেদিকে না গিয়ে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে বলে ফেললেন, সে অধিকার আছে নাকি? বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ আস্তিক। কেউ বলতে পারে নাকি যে ধর্ম মানি না। ইসলাম ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয় না। হারাম কাজ আটকাতে হবে। বিবাহ ছিন্ন না করেই আরও একটা বিয়ে করে ফেললে? হয় নাকি? ইসলামে এসব চলবে না। অবৈধ কিছু চলবে না। আমাদের সমীক্ষা বলছে, তিন তালাকের শিকার মহিলাদের সংখ্যা হাজারে দুটো থেকে তিনটি। আপনি এমন একটা বিষয় নিয়ে লড়াই করছেন, যা অবাস্তব। মুসলমানদের অশিক্ষা নিয়ে প্রচার নেই! সাচার কমিটির বিষয়ে কোনও কথা নেই! গোরক্ষার বিরুদ্ধে কোনও কথা নেই! সভ্য সমাজে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে, কেউ কথা বলবে না? এরা (বিজেপি) কী করে বলে 'মুসলিম দরদী'?
সভ্য সমাজ, বিশ্বের এমন অনেক মুসলিম প্রধান দেশ যারা তালাককে মান্যতা দেয়নি... পাকিস্তান, বাংলাদেশ...
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- কোনও দেশ এইভাবে বলেনি। মিডিয়া বিকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। 'তিন তালাক' নিয়ে কোনও কথা সেখানে উল্লেখ নেই। তারা বলছে পাগলামো করে তালাক দিলে হবে না। মদ খেয়ে তালাক দিলে হবে না। ঘুমন্ত অবস্থায় তালাক দিলে হবে না। সৌদি সরকার বলেনি।
সৌদিতে মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষেধ। আরও অনেক মৌলিক অধিকারও খর্ব করা হয়েছে? ইহা কী ইসলাম পরিপন্থী?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- মহিলাদের জন্য অশুভ এবং অন্যায় পথকে বন্ধ করার জন্য ইসলাম কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছে। এখন মহিলারা যদি তার নৈতিকতাকে রেখে এগুলো করতে পারে তাহলে তো অসুবিধা নেই। এখন তো শুনছি বহু পাইলট মহিলা। সৌদিতে বহু পৌরসভার কাউন্সিলর মহিলারা হচ্ছেন। ইতিবাচক দিকগুলোও তো বলতে হবে। ওখানে মেয়েদের নিরপত্তা সুনিশ্চিত। আমাদের এখানকার মতো ব্যভিচার নেই। ধর্ষণ নেই। মেয়েদের স্বাধীনতা আছে।
মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা বলার জন্য, স্বাধীনতার কথা বলার জন্য সংবিধান তো আছে, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা কী?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- ব্রিটিশ শাসনকালেই তালাকের প্রেক্ষাপটের কথা বলা হয়েছে। পার্সোনাল ল (শরিয়ত অ্যাক্ট) সেই সময় থেকেই 'স্বীকৃত'। স্বাধীনতার আগে থেকেই এই বোর্ড সারা ভারতে কাজ করেছে। ডঃ আম্বেদকরের নেতৃত্বে যে সংবিধান লোকসভায় অনুমোদন পেয়েছে সেখানেও সর্ব সম্মতিতে এটা স্বীকৃতি পেয়েছে যে শরিয়ত অ্যাক্ট ভারতবর্ষের সংবিধানের অংশ, মৌলিক অধিকারের মধ্যেই রয়েছে। পার্সোনাল ল ভাঙা মানে তো সংবিধানকে অমান্য করা। কংগ্রেস কোনও দিন এটা করার চেষ্টা করেনি। বিজেপি এখন এটাই বলতে চাইছে, রাম রাজ্যই হল সংবিধান। হনুমান পুজোই হল সংবিধান। পার্সোনাল ল-তে ফাটল ধরিয়ে মুসলিম বনাম মুসলিম, মহিলা বনাম মহিলা একটা দ্বন্দ তৈরি করা হচ্ছে।
'পুরুষতন্ত্রে'র প্রতিবাদে কোনও মুসলিম স্ত্রী কি স্বামীকে তালাক দিতে পারে?
সিদ্দীকুল্লাহ চৌধুরী- স্ত্রী তালাকের জন্য আবেদন করতে পারেন। নিরুদ্দেশ, পাগল, পুরুষত্বহীন এবং খরপোষ দেন না এমন স্বামীদের বিরুদ্ধে মুসলমান স্ত্রীরা তালাকের জন্য আবেদন করতে পারেন। ইসলাম সম্মত বিধান ব্যবস্থায় শরই-পঞ্চায়েত অনুযায়ী স্ত্রী তালাকের আবেদন করতে পারেন। ইসলাম ধর্ম সমাজের বুনিয়াদকে এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে।