সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ১৪টি। দু'টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের। এই হল সৌমিত্র-সত্যজিতের যুগলবন্দির ফসল। গোটাজীবনের আড়াইশো ছবির মধ্যে যে-ছবিচতুর্দশ নিয়ে আজীবন, সঙ্গত কারণেই, সৌমিত্র গগনচুম্বী আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন এবং বিলিয়েছেনও সে-প্রসাদ স্ব-পরিকরে।


ঠিক যে-কারণে, বেশ কিছু বক্স-অফিস হিট দেওয়া সত্ত্বেও, উত্তমের প্রতিস্পর্ধী নায়কের গা থেকে 'উনি তো ডিরেক্টর্স আর্টিস্ট' এই ক্রিটিসিজমের এলিট গন্ধটা যাই-যাই করেও কখনও পুরোপুরি যায়নি। 


হয়তো এ নিয়ে 'মণিহার' 'বাঘিনী' 'গণদেবতা' 'কোনি'র অভিনেতার গভীরতম মনোবেদনা ঠিক কোথাও না কোথাও শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে ছিলই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাছবির চিরায়ত ধারায় নিজের জন্য ওই 'অপর' তকমাটির প্রতিই যেন একটু বেশি আনুগত্য দেখিয়েছেন তিনি।


আরও পড়ুন:সমাপ্তি


দেখানোর ব্যাখ্যা মজুতই। 'অপুর সংসার' থেকে 'শাখা-প্রশাখা'-- যে-অলৌকিক ছবি-যাত্রা তাঁর একান্তই নিজস্ব অর্জন, সেখানে তিনি এক ও অদ্বিতীয়রূপেই থেকে যেতে চেয়েছেন। এতটাই যে, ওই ১৪ সংখ্যাটিকে তিনি আরও বাড়াতে চেয়েছিলেন। 'গুপী গাইন বাঘা বাইনে' গুপীর চরিত্রটি ভীষণ ভাবে করতে চেয়েছিলেন। দেননি সত্যজিৎ। অনেক পরে চেয়েছিলেন 'আগন্তুকে' মনোমোহন মিত্রের রোলটি করতেও। সে-যাত্রাও বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করেছিলেন সত্যজিৎ।


আশ্চর্যের যে, 'গ্ল্যামার' এবং 'ন্যাচারালিজমে'র যুদ্ধে বরাবর 'ন্যাচারালিজম'কেই জিতিয়ে দেওয়া সৌমিত্র 'মেইনস্ট্রিম' ছবিতেও সংগোপনে সমান আধিপত্য রাখতে চেয়েছিলেন। সেখানে তাঁর লড়াই ছিল উত্তমের সঙ্গে, বলে তিনি দাবিও করতেন। এবং সেখানেও অনেকগুলি ভাল মানের ছবি তিনি বাঙালিকে উপহার দিতে পেরেছেন, এ কথাও ঘোরতর সত্য। অথচ, কী 'মেইনস্ট্রিম' কী 'আর্টফিল্ম'-- কোনও দিক থেকেই জীবনের সেরা সময়ে জাতীয় পুরস্কার পাননি তিনি! সাত দশকের দীর্ঘ ফিল্মজীবনের মধ্যে যদি প্রথম তিনটি দশককেই তাঁর 'যুগ' বলে ধরে নিই, তবে সেই দীর্ঘ এবং গৌরবময় অভিনয়-পর্বে জাতীয় পুরস্কার না পাওয়াটা দুর্ঘটনাই। এ নিয়ে তাঁর যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ তিনি প্রকাশও করতেন। দু'বার ফিরিয়ে দিয়েছেন 'পদ্মশ্রী'। পরবর্তী সময়েও কোনও পুরস্কারই নিতে চাননি এই যুক্তিতে যে, জীবনের সেরা-সময়ে যখন ভাল ভাল কাজের স্বীকৃতি পাননি, তখন আর 'এখন' কেন (অবশ্য পরে মনোভাব বদলেছিলেন, নিয়েওছিলেন বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সম্মান)!


সঙ্গত! এখন নিয়ে লাভ নেই। 


কিন্তু তখন পেলে কী লাভ হত? সৌমিত্র তো গ্ল্যামারমণ্ডিত ছবির জগৎকে কোনওদিনই নিজের ক্ষেত্র বলে মনে করতেন না সেভাবে! তিনি মনে-মনে জানতেন, তাঁর আছেন সত্যজিৎ, মৃণাল, তপন! 


তথাপি 'সংসার সীমান্তে' বা 'কাঁচকাটা হীরে'র জন্যও দরকার ছিল একটা-দু'টো পুরস্কার। শুধু নিজের স্বীকৃতির জন্যই নয়। সিনেমা তো সাহিত্য নয়। একক সৃষ্টির জগৎ তা নয়। বহুজনের শ্রম-স্বপ্ন-কল্পনার মিশেলে ছবি গড়ে ওঠে। তা তৈরিও হয় সংশ্লিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট একটি প্রদেশ থেকে। একজন আঞ্চলিক নায়ক যখন কোনও একটি ছবিতে 'সেরা'র পুরস্কার পান, তখন যে শুধু তিনিই পুরস্কারটি পান, তা তো নয়; পুরস্কার পায় সেই অঞ্চল; পুরস্কার পান সেই ছবির দর্শকেরাও।


আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়


১৪টি সত্যজিতীয় মণিমানিক্য কিন্তু অভিনয়জীবী সৌমিত্রের লং-শটে সেই দ্যুতি আনেনি; দ্যুতি, অতএব, আনেনি তাঁর অঞ্চলে, তাঁর ফিল্মস্টুডিয়োয়, তাঁর টেকনিশিয়ান-বর্গে, তাঁর ভক্ত-কুলে, তাঁর সংস্কৃতিতে, তাঁর আড্ডায়, তাঁর রকে ও চা-দোকানে।


অথচ যে-১৪ নিয়ে সৌমিত্রের এই অজেয় তৃপ্তি, সেখানেও কিন্তু সব সময়ে তিনিই সংশ্লিষ্ট চরিত্রের জন্য 'ফার্স্ট চয়েস' ছিলেন এমনও নয়। শোনা গিয়েছিল, 'অভিযানে'র নরসিংয়ের জন্য প্রথম পছন্দ ছিলেন উত্তমকুমারই। তিনি টানা 'ডেট' দিতে পারেননি বলে পরে সেই অফার সৌমিত্রের কাছে যায়। 'ঘরে-বাইরে'-তেও সন্দীপ মুখুজ্যের (পরে যা সৌমিত্র-অভিনীত) চরিত্রের জন্য প্রাথমিক পছন্দ ছিলেন উত্তমকুমার, নিখিলেশ চৌধুরী চরিত্রের জন্য সৌমিত্র। কিন্তু এ ছবি শেষ পর্যন্ত যখন করতে পারলেন সত্যজিৎ, ততদিনে মারা গিয়েছেন মহানায়ক। সেমতাবস্থায় নিখিলেশ পেলেন ভিক্টর ব্যানার্জী আর সৌমিত্রকে করতে হল সন্দীপ।


তবু, সত্যজিতের সঙ্গে অম্লান জোটবন্ধনে যে অপূর্ব ছবিগুলিতে কাজ করতে পেরেছেন সৌমিত্র, সেগুলির সব ক'টি শেষ পর্যন্ত সর্বত্রগামী না হলেও, বিশ্বসিনেমার প্রেক্ষিতে তা অন্যতর এক চিত্র-রসায়নে সমৃদ্ধ করেছে ভারতীয় ছবিকে। কুরোসাওয়ার মিফুনের মতো, ফেলিনির মাস্ত্রোয়ানির মতো, বার্গম্যানের ম্যাক্স ভন সাইডিউ-র মতো আমাদেরও রয়েছে সত্যজিতের সৌমিত্র!


এ এমন এক অপরাজিত ফিল্মি অভিযান যা পুরস্কারের দুনিয়ায় পরাজিত হতে-হতেও শেষ পর্যন্ত আমাদের সিনেমার দিনরাত্রিকে জুড়ে দেয় সৌমিত্রের 'অপর' সংসারের সঙ্গে। আর তখনই আমরা 'অপুর সংসার'-এর সঙ্গে ঢুকে পড়ি অলৌকিক এক ছবিঘরে!