ভাষাতত্ত্বের গণ্ডিতেই নিজেকে বন্দি রাখেননি সজীব মনের মানুষ সুনীতিকুমার
সুনীতিকুমারের ছিল বনস্পতির উচ্চতা
সৌমিত্র সেন
আদ্যন্ত জীবনরসিক মানুষ। যিনি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অবলীলায় স্নান সেরে নেন। কখনও গাড়ি থেকে নেমে ভিন্ন জনজাতিদের থেকে তাঁদের খাবার চেয়ে চেখে দেখেন। পাণ্ডিত্য বা মেধা, জ্ঞান বা উপাধি তাঁর ভিতরের চির-উৎসুক শিশুমনটিকে কখনও ব্যাহত করেনি। তাই তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল মধুর ও উষ্ণ। এ ভাবে
জ্ঞানচর্চার বেড়াজাল যিনি ভেঙে দিতে পারেন সব দিক থেকে আলো তো তাঁর কাছেই আসে। তেমনই এসেছিল আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। আজ তাঁর জন্মদিন।
১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর শিবপুরের হাওড়ায় জন্ম সুনীতিকুমারের। আগাগোড়া মেধাবী ছাত্র সুনীতিকুমার প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। পরে লন্ডনে গিয়ে ধ্বনিতত্ত্ব ও ভাষাত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্যারিসে গিয়ে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাও করেন। ক্রমে তিনি বিশ্ববিশ্রুত ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত হন। দেশে ফিরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ দেন।
এ হেন বিদ্যাগম্ভীর জ্ঞানবৃদ্ধ মানুষটি কিন্তু ছিলেন বিনয় ও ভদ্রতার দৃষ্টান্তস্থল। এ দেশের অন্যতম প্রাচ্যবিদ সুকুমারী ভট্টাচার্য শুনিয়েছেন সে কথা। একবার সুকুমারী বিদেশি এক অধ্যাপককে সুনীতিবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছেন। কথাপ্রসঙ্গে সেই অধ্যাপককে সুনীতিকুমার তাঁর নিজের সংগ্রহের গ্রিক বইগুলি দেখাচ্ছিলেন। দেখাতে-দেখাতে হঠাৎই একটি বই তিনি বাদ দিলেন। সুকুমারী আশ্চর্য হলেন। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য বইটি নিজে হাতে নিয়ে দেখেন, বইটি সুনীতিবাবুকেই উৎসর্গ করা। নিজেকে উৎসর্গ করা বই কাউকে দেখানোর মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রচার থাকে। তাঁর বিশুদ্ধ শিক্ষা-সংস্কৃতি তাঁকে তা থেকে অনায়াসে নিবৃত্ত করেছিল!
সুনীতিবাবুর বিখ্যাত কাজ 'দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভলেপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ', যেটিকে সংক্ষেপে 'ওডিবিএল' বলা হয়। বিষয়টি নিয়ে 'বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা' বলে একটি বইও তিনি লিখেছেন। লিখেছেন 'ভাষাপ্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ'। তবে বাংলায় তাঁর বিখ্যাত বই 'ভারত সংস্কৃতি'। 'দ্বীপময় ভারত'ও তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এ সব ছাড়াও অসংখ্য গ্রন্থ আছে তাঁর। তাঁর সারাজীবনের সারস্বত সাধনার পরিচয় নেওয়া প্রায় সাধ্যাতীত ব্যাপার। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ে হিউম্যানিটিজের চলমান ভাণ্ডার। পাণিনির দেশের মানুষ তিনি পাণিনির ঐতিহ্যই বহন করেছেন চিরকাল।
কিন্তু তা করতে গিয়ে কখনও শুকনো পণ্ডিত হয়ে থাকেননি। রসের সাধনা থেকে সরে থাকেননি কখনও। শিশির ভাদুড়ীর 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকের পোশাক পরিকল্পনা করেছিলেন এই মানুষটিই, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। সামগ্রিক ভাবে মানুষ, মানুষের খাদ্য-পোশাক-ধর্ম-লোকাচার সংস্কৃতি সব কিছু নিয়েই তাঁর ছিল পক্ষপাতহীন উদার এক জিজ্ঞাসা আর চর্চা।
আগাগোড়া মুক্তমনা, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা, সংস্কারহীন, যুক্তিবাদী মানুষ এই সুনীতিকুমার। আসলে তাঁর মননের তার তো কবেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সারাজীবন তিনি প্রভাবিত রয়ে ছিলেন বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের দ্বারা।
সুনীতিবাবুর ছাত্রেরাও তো বিশ্রুত। তাঁর পরের প্রজন্মের গুণমুগ্ধেরাও এক-একজন দিকপাল। তাঁরা কিন্তু মনের জানলা তাঁর সাহায্যেই খুলেছিলেন বলে স্বীকারও করেছেন। সুকুমার সেন তাঁর গুরু সুনীতিবাবুর কথা কত ভাবেই যে বলেছেন। গুরুর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, অট্টালিকাও উচ্চ, মহীরুহও উচ্চ। একটি নিষ্প্রাণ, অন্যটি জীবনরসে সমৃদ্ধ। সুনীতিবাবুর ছিল বনস্পতির উচ্চতা।
আরও পড়ুন: দুধ না খেলে হবে না ভাল ছেলে!