সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

শচীন কত্তার খুব দুঃখ ছিল, তাঁর ছেলে সুর করতে গিয়ে তাঁকে না আমল দিয়ে অনুসরণ করছে অন্য একজনকে! না, শচীন কত্তার মতো মাপের একজন শিল্পী নিছকই মজা করেই এটা বলেছিলেন! নিশ্চয়ই তিনি হিংসে করেননি তাঁর ছেলে পঞ্চমের আইডল সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরীকে!


হ্যাঁ, আর ডি-র আইডল সলিলই। ৯৫টি বছর পার-করা এ হেন সলিলের জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালের আজকের দিনে, দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। 


রাহুলদেব বর্মন তাঁর কম্পোজার-জীবনে সারা পৃথিবীর সুর ও ছন্দকে ঠাঁই দিতে পেরেছিলেন। তিনি ভারতীয়  লঘু সঙ্গীতের জগতে একটা যুগ। এস ডি-র যুগের প্রতিস্পর্ধী এক চিরবিস্ময়। এ হেন আর ডি বাবার লেগ্যাসিকে যে এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন, যেটা খুব খুব কঠিন ছিল, সেটা  কিন্তু সলিলের জন্যই। সলিল চৌধুরীই প্রথম ভারতীয় ফিল্ম ও নন-ফিল্ম গানের সুরে পাশ্চাত্যের ফ্লেভার আনলেন। অথচ, অত্যন্ত নিবিড় আত্মীকরণের মোড়কে, নিরুচ্চার শৈলীর সূক্ষ্মতায়, ভারতীয়ত্বকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে। কিন্তু তন্নিষ্ঠ শ্রোতার কান সেই ওয়েস্টার্ন ঝড়ের আহ্বান এড়াতে পারল না। যেমন পারেননি কিশোর পঞ্চমও। বাবাকে ঘিরে সর্বক্ষণের সুরের ওমন অপূর্ব ইন্দ্রধনুর বিন্যাস, তা-ও ভিতরে ভিতরে তাঁর সলিল-সমাধি ঘটল। এবং সম্ভবত এ জন্যই পরে তিনি নিজে কাজ করতে এসে হিন্দি ফিল্মি গানকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।



কিন্তু আর ডি-র আগে না হয় সলিল ছিলেন। সলিলের আগে কে? 


দেখতে গেলে কেউ না। আর সেটাই জানিয়ে দেয় প্রতিভা হিসেবে সলিল সত্যিই কত বড়, কতটা অকৃত্রিম, কতটা সৃজনশীল। একটা প্রেক্ষাপট অবশ্য ছিল। তাঁর বাবার ছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের রেকর্ডের দারুণ সম্ভার। বালক বয়স থেকেই সে সবের রসগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সলিলও। হয়তো শোনার সেই অভ্যাসই তাঁর ভবিতব্য নির্দিষ্ট করে দেয়। তিনি নিজের আগ্রহে বহু রকম যন্ত্র বাজাতেও শিখে নিয়েছিলেন। ফলে টেকনিক্যাল দিকের প্রস্তুতিটা আপনা থেকেই হয়ে যাচ্ছিল। এর সঙ্গে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা। যুদ্ধের জেরে মানুষের, মানবতার হতকুচ্ছিত অবস্থা প্রত্যক্ষ করার বেদনা। ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন গড়ে ওঠে। পরবর্তী ক্ষেত্রে যা সারাজীবন তাঁর সাঙ্গীতিক অভিযাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। 


 


সলিল চৌধুরীও তো নিছক একজন গীতিকার-সুরকার নন। তিনিও ভারতীয় লঘু সঙ্গীতের জগতে একটা যুগ। একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড। তাঁর যুগের আর কোনও সুরকার-গীতিকার সম্ভবত এতটা রাজনৈতিক সচেতনতা, মানবতার প্রতি এতটা অন্তর্দর্শন নিয়ে কাজ করতে আসেননি। অথচ তত্ত্ব কখনও গুরুভার হয়ে চেপে বসেনি তাঁর কাজে। গানের সুর তার বাণীর হাত ধরে বয়ে গিয়েছে। কিন্তু কত সৃষ্টি-ছাড়া সৃষ্টিশীলতার খুঁটিনাটি ছাপ যে তার মধ্যেই অনায়াসে রয়ে যেত! 


সচেতনের কানে ও মনে তখন আর গানটা শুধু বিনোদনের বিষয় না থেকে প্রণোদনার সোপান হয়ে দাঁড়াত। না হলে, কী ভাবে বছরের পর বছর ধরে 'গাঁয়ের বধূ', 'রানার', 'অবাক পৃথিবী', 'ঢেউ উঠছে', 'আজ চাকা বনধ' সাধারণ মানুষকে এবং সঙ্গীতশিল্পীদেরও প্রাণিত করবে!


দীর্ঘ কেরিয়ারে অসংখ্য  হিন্দি ও বাংলা ছবিতে সুর দিয়েছেন সলিল চৌধুরী। এর মধ্যে কতগুলি তো মাইলস্টোন। যেমন হিন্দিতে 'দো বিঘা জমিন', 'মধুমতী', 'কাবুলিওয়ালা', 'জাগতে  রহো' , 'আনন্দ'। হিন্দি ফিল্ম সঙ্গীতের প্রেক্ষিতে এ দেশের একটা বড় অংশের সঙ্গীতবোদ্ধা ও তাত্ত্বিকেরা বলে থাকেন, 'কাবুলিওয়ালা' ও 'আনন্দ'-এর মিউজিক ফিল্ম-সঙ্গীতে একটা চূড়ান্ত স্কেল। এ দু'টি ছবি না হলে পরবর্তী কালের অনেক ছবির অনেক গানই বাঁধা হয় না।


আর বাংলায়? সেখানেও তো মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি। 'পাশের বাড়ি', 'একদিন রাত্রে', 'বাড়ি থেকে পালিয়ে',' গঙ্গা', 'কোমল গান্ধার', 'আকালের সন্ধানে'। গুটিকয় উল্লেখ করা হল। কিন্তু ধারে ও ভারে এগুলি যে কোন মানের, রসিক মাত্রেই তা জানেন। হিন্দি ও বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার ছবিতেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন।


সলিলের প্রসঙ্গে গণসঙ্গীতের কথা আসবেই। সেই পর্বে সময়ের একটা চাহিদা ছিল। সেই সাময়িকতার বেড়ার ভিতরেও সলিল অমর সব সৃষ্টি করে গিয়েছেন। আজ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত বদলে যাওয়ার পরেও যে-গান মানুষকে টানে। 


তিন জন বিশিষ্ট শিল্পীর সঙ্গে সলিল চৌধুরীর কাজ সঙ্গীতের অমর সুরলোকে ঠাঁই পেয়েছে। লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এর মধ্যে বলা বোধ হয় খুব ভুল হবে না যে, সলিলই ভারতকে প্রথম দেখিয়েছিলেন, লতাকে ঠিক কোন কোন স্পেকট্রামে ব্যবহার করা যায়! লতাকে বাংলা গানেও বিপুল ভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। হেমন্ত-সলিল জুটি তো বাংলা গানে আলাদা করে একটা বহুবর্ণিল বহুবিচিত্র অধ্যায়। 



আর মান্না দে? সলিল-মান্না সত্যিই এক স্বর্গীয় যোগাযোগ। দু'জনেই সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সমান বিচিত্রগামী, সমান সেরিব্রাল, সমান স্কিলফুল, সমান পারফেকশনিস্ট। একজনের সুর (এবং কখনও-কখনও বাণীও) এবং অন্য জনের কণ্ঠ যেন পরস্পরের সৃজনধর্মিতার পরিপূরক ছিল। তান-মীড়-আবেগ-উত্তাপ-জোয়ারি মিলিয়ে সলিল-মান্নার যৌথ সৃষ্টি ভারতীয় সঙ্গীতের মঞ্চে তুলনায় স্বল্প-আলোচিত কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে গুরুত্বপূর্ণ এক সোনালি-পর্ব।


সব মিলিয়ে সলিল চৌধুরী আজও দারুণ প্রাসঙ্গিক। তাঁর নিজের কণ্ঠের গানও তো আছে। সেখানেও 'এই রোকো' যেন আজকের লিরিক মনে হয়। 'এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়' তো আপাত ফিচলেমির মোড়কে এক শাশ্বত উচ্চারণ! তাই এই প্রজন্ম তো বটেই, পরবর্তী প্রজন্মকেও ফিরে ফিরে আসতে হবে সলিলসঙ্গীতের কাছে।


আরও পড়ুন: সাতাশিতে এসে থামলেন 'যৌবনবাউল' অলোকরঞ্জন