সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিক


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ট্রোলিং বিষয়টা একটা বীভত্‍স মজায় পরিণত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যেমন পারছে, যেমন-তেমন ভাবে মানুষকে হেনস্থা করার মানসিকতা 
নিয়ে ট্রোল করছেন। এই কুরুচিপূর্ণ জিনিসটা কিন্তু এত খোলাখুলি ভাবে সমাজে আগে ছিল না। আগে মানুষ অন্তত কিছুটা হলেও নিজের আওতায় থেকে কথা বলত। 


হ্যাঁ, একটা চায়ের আড্ডা বা বাড়ির ভিতরের আড্ডা হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে, সেখানে যে কেউ যে কারও প্রতি
 বিষোদগার করত। আমরা সেটাকে মূলত পরনিন্দা, পরচর্চা হিসাবেই দেখতাম। কারওর বিরুদ্ধে বিষোদগার যিনি করছেন তিনি কোনও একটা কারণ আছে বলে বা তাঁর প্রতি রাগ আছে বলে হয়তো সেটা করছেন। সেটা আলাদা। 


কিন্তু ইদানীং ট্রোলিংয়ে (Trolling) এক বীভত্‍স রস দেখা যায়। আমি কারও চামড়া টেনে ছাড়িয়ে নিচ্ছি, তাতে একটা বীভত্‍স উল্লাসের আবহ তৈরি হচ্ছে এবং তাতে আরও তিনশো পঁয়ষট্টি জন মজা পাচ্ছে! এ জিনিস ভাবা যায় না। অথচ এটা এখন আমাদের বাস্তবতার একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে সত্যিই খুব বড় এক বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যারা মোটামুটি ভাবে সভ্য জগতে বসবাস করছি তাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। একেবারে রিমোট, একেবারে প্রান্তিক যাঁরা, তাঁরাও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া করেন। এরকম কোনও মানুষ নেই যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়া (Social Media) করেন না বা সোশ্যাল মিডিয়া যাঁর লাইফে বাস্তব নয়। আমাদের শোওয়া, বসা, খাওয়া যেমন সত্যি, আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার লাইফও তেমন। আমাদের সোশ্যাল লাইফ যেমন সত্যি, আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া লাইফও তেমন সত্যি।


আরও পড়ুন: Trolling: এর পিছনে সামাজিক বৈষম্যের গভীর প্রভাব আছে


আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটা 'কোড অফ কন্ডাক্ট' মেনে চলার চেষ্টা করি। আমার পোস্টে, আমার টাইমলাইনে আমি কারও সম্পর্কে একটা মতামত দেওয়া, তাঁর সমালোচনা করা, তাঁকে নিয়ে একটু মজা করে  পোস্ট-- এগুলি দিই। কিন্তু আমি কারোর পোস্টে গিয়ে লুম্পেনের মতো তাঁকে আক্রমণ করা, 
অসভ্যতা করা এ কখনও করি না, করবও না। 


কিন্তু এটারই সম্মুখীন এখন আমাদের সবাইকে হতে হচ্ছে। আমি খুব সম্প্রতি এটা নিয়ে একটা পোস্টও করেছি। সেই পোস্টে আমি বলেছি--  ফোন জিনিসটা আমরা আবিষ্কার করিনি, মোবাইল ফোন আবিষ্কার করিনি, নেট আবিষ্কার করিনি, ফেসবুক-টুইটার তৈরি করিনি। এই সবে আমাদের কোনও অবদান নেই। 
এর পেছনে অনেক মেধা আছে, এর পেছনে ক্যাপিটালিজম আছে, এর পেছনে আরও অনেক কিছু আছে। কিন্তু এতে আমাদের অংশগ্রহণ সেরকম ভাবে নেই। আমরা শুধু পয়সার বিনিময়ে এগুলোকে ব্যবহার করছি । সেইজন্য আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে আমাদের কোনও দায়িত্বই নেই। কিন্তু তা নয়।
 আমাদের অন্তত একটা 'কোড অফ কন্ডাক্ট' মেনে চলা উচিত। এত সব জিনিস দিয়ে কিছু মেধাবী মানুষই পৃথিবীটাকে পাল্টাচ্ছে, তাকে উপভোগ্য করছে। আর আমি সেসব স্রেফ উপভোগ করছি, এর পিছনে আমার আহামরি কোনও অধ্যবসায় নেই। তাই অন্ততপক্ষে একটা 'কোড অফ কন্ডাক্ট' তো থাকতে পারে! আমি এটা করব, এর বাইরে যাব না। 


আমি তো বীভত্‍‍স ভাবে ট্রোলড হই। আমি একজন লেখক। আমি নানা ধরনের মতামত, নানা ধরনের চিন্তাভাবনা ফেসবুক পোস্টে দিই। এই তো, আমি এক লক্ষ শব্দের একটা গোটা উপন্যাস (Novel) লিখলাম! কই! তখন তো কাউকে ভাল কিছু বলতে দেখলাম না! যাঁরা এই ধরনের পোস্টগুলিতে একটা লাইকও করেন না, একটা কমেন্ট করেন না, একটা মতামতও জানান না, কোনও দিন একটা ভাল কথা বলেন না, তাঁরা কিন্তু পান থেকে চুন খসলে বেরিয়ে আসেন এবং বীভত্‍স রকম ট্রোল করেন। হাজার হাজার ফলোয়ারের ভেতরে কোথায় এঁরা ঘাপটি মেরে বসে থাকেন কে জানে!


যেমন খুব সম্প্রতি আমার একটা সিগারেট খাওয়া ছবি নিয়ে ট্রোলড হলাম। ছবিটা পাঁচ বছরের পুরনো। হাতে একটা সিগারেট। সেই শুরু। আচ্ছা, আমি ছেচল্লিশ বছরের এক লেখক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Sangeeta Bandyopadhyay)। আমাকে কি বলার দরকার আছে, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর? যিনি এটা মনে করেন, যে আমাকে এটা বলার দরকার কাছে, তিনি কতখানি ইগনোরেন্ট, কতখানি অহং তাঁর, কতখানি মূর্খের স্বর্গে তিনি বাস করেন! অনেক শিক্ষিত ভদ্র-সভ্যই আমাকে এই কথা বলেছেন! এঁদের মধ্যে সেই স্পোর্টিং স্পিরিটটাই নেই। যদি তোমার মধ্যে স্পোর্টিং স্পিরিট না থাকে, তবে ঘরে বসে থাকো। কেন ফেসবুকে আস? কেন পঞ্চাশটা মানুষকে ফলো করো? কী নিতে চাও তাঁদের থেকে? একটা সিগারেট হতে ধরা ছবি দেখে এঁরা এমন উত্তেজিত হয়ে যান যে সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি জ্ঞান আমাকে দিতে চান! এর তো কোনও প্রয়োজন নেই। সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর-- এটা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাঁরা বলবেনই। আর সেই বলাটা কখনও এমন বিশ্রী জায়গায় চলে যাবে যে, চিন্তাও করা যাবে না। এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। 


এঁরা আবার দুটো দল। একদল প্রচণ্ড প্রগতিশীল। তাঁরা যে কোনও জিনিসে খুব সহজেই অফেন্ডেড হন। আরেক দল আছে প্রচণ্ড রিগ্রেসিভ। প্রচণ্ড প্রগতিশীল আর প্রচণ্ড রিগ্রেসিভ-- এই দুটি দলই ট্রোল করতে ভালোবাসে মানুষকে। 


কিছুই কাউকে বলা যাবে না! কিন্তু কেন বলা যাবে না? তবে তো লেখাও যাবে না! সাহিত্য তো আকাশ-বাতাসকে নিয়ে রচিত হয় না। সাহিত্যে একটা বড় উপাদান তো মানুষ, মানুষের জীবন। সেখানে তো মানুষকে ক্রিটিক্যালি দেখানো হয়। তা হলে সেটা কি দেখানো যাবে না, বলা যাবে না? শুধু কি ভাল-ভাল বলতে হবে? ন্যক্কারজনক। 


আমি এই ধরনের ট্রোলিংয়ের প্রচুর শিকার হয়েছি। কিন্তু আমি নিজেকে তাঁদের থেকে আলাদা মনে করি। আমিও মানুষের সমালোচনা করি, আমিও মানুষকে নিয়ে হাসাহাসি করি। কিন্তু আমি একটা কোড অফ কন্ডাক্ট মানি। যাঁরা কুত্‍সিত ভাবে মন্তব্য করেন আমি সেগুলি উঠিয়ে দিই। যাঁরা নেহাতই হালকা ভাবে নেন, বা আলোচনার মধ্যে আসেন, মতানমত জানান, হাসি-ঠাট্টা করেন--সেগুলিই রাখি। যাঁরা খারাপ ভাব ব্যক্ত করেন, সেই কমেন্ট ডিলিট করে দিই। এটা আমার কোড অফ কন্ডাক্ট। আমি অন্যের পোস্টে অসভ্যতা করি না। আই জাস্ট ইগনোর। 


এটা সবাইকে শিখতে হবে। শুধু  সমালোচনা করে হবে না। কী করবেন তাঁরা-- এটাও তাঁদের বলতে হবে, এটাও তাঁদের শিখতে হবে।  আমি মনে করি, এটা শেখা খুব দরকার।


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: অফ-শোল্ডার টপের আড়াল থেকে দেখা যায় যে-কাঁধ, কেন সেই কাঁধ বহন করতে পারবে না শোকের ভার প্রকাশ্যে?