ঋত, এখনও ফিরে আসা যায়, প্রত্যয়ী `ঘরে ফেরা` নেপালদেব
৯০ দিনের রক্তক্ষণের পর সিপিএমের বিরুদ্ধে কামান দেগেছেন বিদ্রোহী নেতা ঋতব্রত ব্যানার্জি। 'বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বেঁধে' তাবড় ছাত্রনেতা 'বাজারি' করেছেন দলেরই একেবারে শীর্ষস্তরের নেতাকে। পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল করেছেন বাকপটু ঋত। ছাড়েননি সাংসদের ছেলে রাসেল আজিজকেও। আর এতেই যেন ভূমিকম্প! ত্রিভূজাকৃতি দলের মাথা থেকে পা যেন আইসিইউ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক লহমায় হয়ে গেল উইসেন বোল্ট, বিদ্যুৎ গতিতে রাজ্য পার্টি সিদ্ধান্ত নিল, 'পচা আলুকে আর দলে রাখা যাবে না, তাড়াতেই হবে'। সিপিএম সাংসদ ঋতব্রতর বহিষ্কারে সিদ্ধান্ত এখন কেবল কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায়। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, 'বেশ হয়েছে', এটাই নাকি সিপিএমের 'ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত'। তবে এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাষিয়ে বৈভবে ভরা সিপিএম নেতাকে সংশোধনের রাস্তা দেখালেন দলেরই এক সচ্চা কমিউনিস্ট। 'ফিরতে চাইলে পথ আছে', অভিজ্ঞতা দিয়ে শেখাতে চাইলেন একদা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আবারও ফিরে আসা নেপালদেব ভট্টাচার্য।
প্রশ্ন- সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যসভায় সবথেকে ভাল পারফর্ম করা সাংসদকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দলের কত বড় ক্ষতি?
শুধু ভাল পারফর্ম্যান্স করেছে সেজন্য ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক নয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসতে গেলে তার একটা বড় প্রক্রিয়া থাকে। সেই পক্রিয়া সম্পন্ন করে যখন তা শেষ করে দিতে হয়, সেটা সবসময়ই ক্ষতির। এমপি হন বা না হন কিংবা সংগঠক হন অথবা একটা মুখ হিসেবে যেকোন স্তরেই থাকুন না কেন, চলে যাওয়া অবশ্যই ক্ষতি। ঋত'র না থাকাটা নিশ্চয়ই বড় মাপের ক্ষতি।
প্রশ্ন- দলের এই সিদ্ধান্ত কি সঠিক?
একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই একমাত্র বিচার করা যায়, তা ভুল না ঠিক। সেটা অনেক সহজ। একবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে সেটার আর ভুল ঠিক বিচার করা যায় না। মেনে নিতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে মান্যতা দেওয়াটা সব স্তরেই হয়। বাকিটা ইতিহাস প্রমাণ করবে।
প্রশ্ন- ঋতব্রত ব্যানার্জির বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দলের বিরাট ফেস লস, কীভাবে সামলাবে দল?
যদি মানুষ বোঝে ঋতব্রত যা করছে সেটা কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না, কমিউনিস্ট পার্টি ঠিকই করেছে, সেটা আমাদের মেনে চলতেই হবে। তাছাড়া কোনও উপায়ও নেই।
আমি মনে করি না দল ধাক্কা খেয়েছে। 'ফেস লস' হয়নি। ঋত'র বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের কথাই মানুষ জানেন, তারাই বিচার করবে। আমরা বিশ্বাস করি, ব্যক্তির থেকে পার্টি বড়। এটা যদি হয়, তাহলে যে ব্যক্তি বহিষ্কৃত হলেন, তাঁর ওজন দিয়ে কিছু যায় আসে না। কারণ, পার্টির ওজন তাঁর থেকে সবসময় বেশি। পার্টি মানে লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যাপার। তাদের আবেগ, ভালবাসা, দুঃখ, রক্ত, ঘাম ভীষণরকম জড়িয়ে থাকে। তার ওজন কখনই কোনও ব্যক্তির থেকে কম হতে পারে না।
প্রশ্ন- ৯০ দিনের রক্তক্ষরণের পর এই বিস্ফোরণ ঘটালেন তরুণ সাংসদ, এতে দল কতটা রক্তাত হল?
আমাদের চেতনা যখন বিকশিত হতে শুরু করল, আমরা নিজেদের মার্ক্সবাদী ভাবতে শুরু করলাম, কমিউনিস্ট হওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম, তখন আমরা একটা বড় পরিবারে যোগ দিলাম। সেই গোটা পরিবারের বিরোধিতা করে প্রকাশ্যে আসাটা, কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেই ভুলটাই ঋত করেছে। 'ইনার পার্টি স্ট্রাগল' বলে একটা কথা আছে। পার্টির মধ্যে অভ্যন্তরীণ লড়াই। সেটা করলে এক জিনিস হত। কিন্তু সেটা না করে গোটা বিষয়টা সামনে আনলে তখন বল আর পার্টির কোর্টে থাকে না।
প্রশ্ন- এর আগেও তো অনেকবার দলের সিদ্ধান্ত বাইরে বেফাঁস করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত নেতা পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা বাম সরকারকে বলেছেন 'চোরেদের সরকার'। তখন তো পার্টি এত কঠোর হয়নি!
একটা ঘটনা। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ধারাবাহিক রাজনৈতিক জীবনে কেবল একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়াটাও ঠিক হবে না। তিনি হঠাৎ এই মন্তব্যটা করেন, কিন্তু পরে প্রত্যাহারও করে নেন। তিনি বলেছেন, 'ভুল করেছি'। ঋতও যদি ভুল স্বীকার করত, তাহলে তো বহিষ্কারের বিষয়টাই আসত না।
প্রশ্ন- ঋতব্রত এখন যদি বলে ভুল হয়েছে, তাহলে?
ঋত বোধহয় ভুল হয়েছে বলার সময়টাও পার করে ফেলল।
প্রশ্ন- সোমনাথ চ্যাটার্জি, নৃপেন চক্রবর্তীদের মত কিংবদন্তি কমিনিউস্টদের সঙ্গে নাম জুড়ল ঋতব্রত ব্যানার্জির, কী বলবেন?
না, না। কোনও ক্ষেত্রেই বিষয়গুলিকে এক করা যায় না। সোমনাথ চ্যাটার্জিকে বহিষ্কার করার যে কারণ, তার প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব, পার্টির সঙ্গে বিরোধ, একজন স্পিকার পার্টির লোক কিনা এমন অনেক বিষয় জড়িয়ে ছিল। সারা ভারতবর্ষের রাজনীতি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। নৃপেন চক্রবর্তী খুবই বড় মাপের নেতা, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। তাঁরও স্পষ্ট বক্তব্য ছিল। গোটা পলিটব্যুরো তাঁর বিপক্ষে চলে গিয়েছিল, কিন্তু নিজের বক্তব্য থেকে সরেননি তিনি। পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্ত মানলেন না। এর দায় এবং দায়িত্ব তাঁরই। সোমনাথ চ্যাটার্জিকে এতটা ফ্ল্যাটভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তিনি মনে করেছেন, একজন স্পিকারের সবসময়ই 'নন পার্টি ম্যান' হওয়া প্রয়োজন। একটা পার্টি থেকে এলেও স্পিকারকে সবার বিষয়ই কম বেশি দেখতে হয়, বুঝতে হয়। সেই জন্য ওই মুহূর্তে তিনি নিরপেক্ষ। ঋত'র সঙ্গে এই বিষয়গুলি একেবারেই মেলে না।
প্রশ্ন- গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন আপনিও, কামব্যাক করার লড়াইটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে পার্টির কাছে ভুল খবর রয়েছে। আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। সুতরাং আমার প্রত্যয়টা অন্যরকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। পার্টির নেতাদের কাছে একটা খবর গেল, সেটা তাঁরা রাজ্য কমিটিকে জানালেন, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সবাই সেটা মানলেনও। আমি মনে করি না যারা আমার বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে হাত তুলে সমর্থন করেছেন তাঁরা সবাই অপরাধী। আমার মনে হয়েছিল পার্টির এই ভুলটা ভাঙবে। পার্টির একটা বড় অংশও বিশ্বাস করত একটা গণ্ডগোল রয়েছে। পার্টির ভিতরে-বাইরে, নেতা-কর্মী কেউই আমাকে গুপ্তচর হিসেবে কখনও দেখেনি। আমি সবসময়ই নিজেকে পার্টির কাজে নিযুক্ত রেখেছি। কিন্তু প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে একটু দেরিই হল। ৬ বছর পর পার্টি সদস্যপদ ফিরে পাই। ১৪ বছর পর রাজ্য কমিটিতে ফিরে এলাম। অতএব ভুল প্রমাণিত হল। ভুল তো মানুষই করে। আমাকে যে ধারায় বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেখান থেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে আর কেউ এখনও ফিরে আসতে পারেছে বলে আমার জানা নেই। প্রথমত প্রত্যয় আর দ্বিতীয়ত কমিউনিস্ট পার্টিকে আত্মোপলব্ধি করতে পারা, আমি এই দুই কারণেই ফিরতে পেরেছি।
পার্টি মানে কি শুধু কয়েকজন নেতা? আমি কিন্তু কখনই তেমনটা মনে করিনি। ৬-এর দশক থেকে ৯-এর দশক পর্যন্ত, আমার সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক ৩১ বছরের। তারপর বহিষ্কার। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে অসংখ্য মানুষ আমাকে নেতা হিসেবে সম্মান করেছেন, ভালবেসেছেন। তাঁদের সবার বিরোধিতা আমি করতে পারব না। এঁরাও তো পার্টি। আমি এঁদের বিরোধিতা করি কীভাবে? এর ফলে যেটা হল, সহকর্মী থেকে অনুজ-অগ্রজ, সবার সঙ্গেই মিছিলে হেঁটেছি আমি, তাঁরাও আমাকে জায়গা করে দিলেন। পার্টির কমিটি মিটিংগুলিতে বসতে পারিনি ঠিকই কিন্তু পার্টি থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন ছিলাম না। যার ফলে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। একদিনের জন্যও অনুভব করিনি আমি কমিউনিস্ট পার্টির মূল স্রোতের সঙ্গে নেই।
প্রশ্ন- বহিষ্কারের পর দলে ফিরতে হলে কী কী করতে হবে 'কমরেড' ঋতব্রতকে অবশ্য তিনি যদি ইচ্ছুক হন?
কমিউনিস্ট পার্টি কখনই উচ্চাকাঙ্খা পূরণের পথ নয়। পার্টিকে সিঁড়ি ভেবে কায়দা করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে, এটা কখনই আমি ভাবিনি। দলে ফিরতে পারবে না, এই 'না' বলে কিছু হয় না। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছে, আরেকটা প্রক্রিয়া দিয়ে ঋতব্রত দলে ফিরে আসতেই পারে। ঋতব্রতর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলে ওর মনের ভাবটাও জানতে হবে, ওকে জিজ্ঞেস করব, 'ভাই তুমি ফিরছ'?
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই ঋতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। যেটা করছ, ভুল করছ, এখন কী করা উচিত, অনেক আলোচনাই হয়েছে। আমি ঋত'র প্রতি স্নেহশীল। পরিবারের কোনও ছোট যদি ভুল করে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ তো নেই সমাজে। বোঝানো, বকা এসব তো থাকে। পরিবারের বিরোধ বাজারহাটের ব্যাপার হতে পারে না, এটা কাঙ্খিত নয়। আমি যেভাবে পার্টি বুঝেছি, সেটা ঋত বোঝেনি। পার্টি মানে কয়েকজন নেতা নয়, ঋত যদি এটা বুঝত...! সবাই তো চায়নি ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক, কেউ কেউ মনে করেছে। ঋত একজন নেতার বিরুদ্ধেই বারে বারে বলছে। তিনি একা তো আর গোটা পার্টি নন। বাকি পার্টিকে ওর ভরসা করা উচিত ছিল। নিজের ফলোয়ার কমরেডদের উপর আরও আস্থা রাখা উচিত ছিল ঋত'র।
প্রশ্ন- গৌতম দেব, নেপাল দেব, সুজন চক্রবর্তীদের পাশে পাবেন ঋত?
আমাদের পাশে দাঁড়ানো, না দাঁড়ানোটা বিষয় নয়। আগে ওকে ঠিক করতে হবে...। দুজন নেতাকে টার্গেট করে কমিউনিস্ট পার্টি করতে চাইলে ফেরা মুশকিল। অনেক মানুষ, অনেক শহিদ, অনেক মানুষের আত্মত্যাগ, এর সঙ্গে লাখো লাখো মানুষের সম্পর্ক আছে, এটা বুঝতে পারলে ঋত'র ফিরে আসা একেবারেই কঠিন নয়। 'হ্যান্ড ফুল অব লিডার্স নাকি ক্রোরস অব পিপলস', কোনটা পার্টি? বুঝতে হবে।
প্রশ্ন- ঋতব্রত'র অল্টারনেটিভ কি দলে আছে?
বক্তা হিসেবে ঋতব্রত'র অল্টারনেটিভ এই মুহুর্তে পার্টির কাছে নেই তা ঠিকই, কিন্তু তা আবার অপরিহার্যও নয়। যখন ঋত ছিল না তখন কি কোনও শূন্যতা ছিল? ঋত আসার পর চোখে পড়ল। ঋত চলে যাওয়ার পর মনে হবে শূন্যতা তৈরি হল, কিন্তু আবারও কোন ঋত তৈরি হয়ে যাবে। এটা একটা চলমান পক্রিয়া। এই ভাবেই চলবে। ওর চলে যাওয়া দুঃখজনক, বেদনাদায়ক। কিন্তু অপূরণীয় নয়।