বাংলার পট শিল্পকে বিশ্বের দরবারে বিখ্যাত করেছিলেন, রঙ—তুলির জাদু দেখানো শিল্পীর আজ জন্মদিন
শিল্পীজীবনের শুরুতে পাশ্চাত্য চিত্র রীতিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন এই অবনীন্দ্র—শিষ্য।
সুমন মহাপাত্র— স্বদেশের অবহেলিত শিল্পাকলাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন তিনি। শিল্পের মাধ্যমে দেশপ্রেমের পরশ আঁকতেন। বেলিয়াতোড়ের পটুয়ায় রঙ—তুলির টান যেন একেকটা ম্যাজিক শো।
"পট যায় ঘুরে
অন্ধীকৃত রাত্রির শহরে,
পথে পথে সুগম্ভীর ছায়ার বহর,
ষড়যন্ত্র সঙ্কুল ত্রস্ত কবন্ধের ভীড়।
সুর-রিয়ালিষ্ট কবিতার দেশে।
পিকাসো বা যামিনী রায়ের আঁকা
পথঘাট গাছপালা বাড়ি।" - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মিত্রর কবিতায় এভাবেই অমর, বাংলা সহ সারা বিশ্বের অন্যতম চিত্র যাদুকর যামিনী রায়।
ছোটবেলায় বাড়িতে একেবারেই মন বসতো না যামিনীর। হন্যে হয়ে বাবা রামতরণ ছোট্ট যামিনীকে খুঁজে বেড়াতেন। শেষ পর্যন্ত দেখা মিলত পাড়ার পটুয়াদের আস্তানায়। গ্রামে দুর্গাপুজো হোক কিংবা কালী পুজো, যামিনীর আসল আকর্ষণ ঠাকুর গড়ার কৌশল দেখা। সারা দিন নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে যামিনী বসে থাকতেন পোটো পাড়ায়। বাড়ির দেওয়ালে আঁকিবুকি কাটতে কাটতেই বড় হয়ে ওঠেন চিত্রশিল্পের মহান যাদুকর যামিনী রায়। ভর্তি হন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। সেখানে বাঁকুড়ার পটুয়া যামিনীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পাশ্চাত্যের আর্ট। যামিনীর সঙ্গে পরিচয় হয় পিকাসো, সেজান ও ভ্যান গগের চিত্রকলার।
শিল্পীজীবনের শুরুতে পাশ্চাত্য চিত্র রীতিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন এই অবনীন্দ্র—শিষ্য। কিন্তু ধীরে ধীরে শিকড়ে ফেরেন পদ্মভূষণ যামিনী রায়। কালীঘাটের পটশিল্প হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। কালীঘাটের চিত্রকলার মূল বিষয়বস্তু ছিল পৌরাণিক চরিত্র, পশুপাখি, গ্রাম্য চিত্র। এতেই মজে ছিলেন এই মহান চিত্রকর। তাঁর চিত্রকলায় ফুটে উঠেছিল গ্রাম বাংলার মুখ। বাংলার পটশিল্পকে তিনি করে তুলেছিলেন বিশ্বের পটশিল্প। সোজাসাপটা গ্রাম্য চিত্র, তাতে কালো তুলির টান! পটশিল্পে ভর করে কখনও রূপ দিয়েছেন সাঁওতাল জননীকে। কখনও দেবী দুর্গা তাঁর তুলিতে ধরা দিয়েছেন গ্রাম্য নারী হয়ে! কখনও এঁকেছেন যিশু, কখনও কৃষ্ণ। শিল্পী বললে রাগ করতেন যামিনী রায়। নিজেকে পটুয়া বলতেই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতেন বাঁকুড়ার যামিনী। সবসময় নিজের শিল্পে দেশজ রঙই ব্যবহার করতেন তিনি, গ্রাম বাংলার পটুয়াদের মতো মেটে রঙকেই প্রাধান্য দিতেন। ভুসাকালি, খড়িমাটির রঙে প্রাণ দিয়েছেন রামায়ণ কথা, চৈতন্য কথাকে।
দেশপ্রেমে অবিচল যামিনী রায়, একাধিকবার সুযোগ পেলেও যাননি বিদেশে। তিনি বলতেন, "আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা। ওরা এসে আমাদের দেখে যাক।" কবি বিষ্ণু দে ছিলেন যামিনী রায়ের একাত্মা বন্ধু। তাই তো মান্না দের বিখ্যাত গানে, "একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত। কখনও বিষ্ণু দে, কখনও যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলত।" কবিগুরুও ছিলেন যামিনী চিত্র প্রেমে আপ্লুত। বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেমন মিশে আছে দুর্গাপুজো, কলকাতা, ব্যোমকেশ, ঠিক তেমনই ষোলো আনা বাঙালীয়ানা বজায় রেখেছিলেন বাংলা চিত্রশিল্পের এক এবং অদ্বিতীয় পথিকৃত্ যামিনী রায়। ১১ এপ্রিল, আজ তাঁর জন্মদিন। শিল্পীকে শ্রদ্ধার্ঘ।