কেশের বন্ধন। বন্ধনী নিয়ে চুলের নানান বিশ্ব পরিচিতি আছে, তাঁদের মধ্যে হতচ্ছাড়া এক স্বতন্ত্র কেশ জাতের নাম 'ড্রেডলক'। ইংরাজী শব্দ 'LOCKS' (অনেক ক্ষেত্রেই যা লেখা হয় LOCS) এবং 'DREADS' অথবা সংস্কৃত ভাষায় জটা-কেশসজ্জার এই রূপ একেবারেই আধুনিক নয়, বরং আদি। ইতিহাসের আদি অধ্যায়ের পাতা উল্টে পাল্টে দেখলেই জটার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে সমস্ত ধন্দ্বের অবসান ঘটে যায়। হিন্দুত্ব, বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্মে এই ধরনের কেশ বন্ধনীর প্রচলন ছিলই, পরবর্তীতে আফ্রিকায় এর প্রচলন হয় সর্বাধিক। প্রচলন থেকে বিশ্ব পরিচিতি এবং পপুলারিটি বাংলায় যাকে বলে লোকপ্রিয়তা, নিঃসন্দেহে ড্রেডলক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবল মাঠ থেকেই। এখন ক্রিকেটেও আছে ড্রেডলক। তবে মার্কিনরা যেমন সবেতেই নিজেদের আধিপত্য কায়েমে প্রথম জন হওয়ার চেষ্টা করে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমেরিকা রাগবি খেলাতেও 'ড্রেডলক' অথবা জটার ওপর একটা স্বতন্ত্র এবং লোকপ্রিয় স্ট্যাম্প লাগাতে শুরু করে। সালটা ১৯৯০। রাগবি মাঠের জটাধারীদের পরিচয় সার্বজনীন হতে শুরু করল। মাঠ ভর্তি দর্শক থেকে খবরের পাতা, ড্রেডলকের মানে হয়ে দাঁড়াল 'ডিফেন্সিভ ব্যাক'। দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অল হ্যারিস, রিকি উইলিয়াম, ড্রিউ গডেন, লেরি ফিতজেরাডদের মত অ্যাথেলেটদের মানুষ চিনতে শুরু করল জটা দিয়েই। পেশাদারদের পরিচয় হল, 'ওই খেলোয়াড়, যার ড্রেডলক আছে'। নারকেলের দড়ির মত হুবুহ দেখতে কেশের সজ্জায় বিশ্বমাত। অনেকেই মনে করেন, জটা ঈশ্বর প্রদত্ত (একান্ত আপন বিশ্বাস), সেখানে চুলে চিরুনি তল্লাশি নিষিদ্ধ। নোংরা জমে জমে জটা হয়, এই ধারণা সর্বৈব সত্য নয়। যত্ন সহকারেও 'ড্রেডলক' তৈরি করা যায়, আধুনিক সমাজ তো তাই করে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


 


জটার ইতিহাস


সে সময় ক্যামেরা আবিষ্কার হয়নি। চোখে দেখে চাক্ষুষ দর্শনের মতও কিছু ছিল না। তবে ছিল শিল্প। ভাস্কর্য, স্থাপত্যের নিদর্শনে আদিকালের রাজা, পাদ্রি এবং নামীদের কেশ সজ্জিত থাকত ড্রেডলকে। ৬১৫ থেকে ৪৮৫ বিসি এই সময়ে গ্রীকদের মধ্যে ড্রেডলকের প্রচলন ছিল,  ভাস্কর্য, স্থাপত্যে খোঁদাই আছে সেই নিদর্শনই। যুদ্ধক্ষেত্রেও বীরেরদের পরিচয় ছিল এই জটা। 'স্পার্টান'। ইতিহাসের বীর শ্রেষ্ঠদের তালিকায় যারা একেবারে প্রথম সারিতে, সেই স্পার্টানদের শরীরী ভাষা, তাঁদের অস্ত্র, তাঁদের হুঙ্কারের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল ড্রেডলক। এমনকি ইসলামের সুফি আন্দোলনের সময় (১৮৮৭ সাল) শেখ আমাদু বম্বা মাক্কেও জটাধারী হয়েই লোকপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে ছিলেন।



 



'জটা হি ধর্ম, জটা হি কর্ম'


সাধু-সন্তদের মাথার জটায় ঈশ্বরের বাস। এমনটা আগেও ছিল, এই বিশ্বাস আছে এখনও। জটাধারী শিবের জটা থেকেই নেমে এসেছিলেন গঙ্গা। জটাতেই নাকি গঙ্গাকে ধরে রেখেছেন দেবাদি দেব মহাদেব। মাইথোলজি, মিথ কখনও ভাঙার জন্য তৈরি হয়না, বরং মিথ সেই পর্বতশৃঙ্গ যেখানে বরফের চূড়া আদি থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হয়। এতো না হয় ধর্মের কথা। জটা রাজনৈতিক জবানিও। বোহেমিয়ান ববের কথা কি ভুললে চলবে? "অনেকে বৃষ্টিকে অনুভব করেন, আর কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভেজেন", বব মার্লের এই ঐতিহাসিক উক্তি কার না মনে আছে। এখনতো গুগুল করলেই প্রথমেই থাকে এই কোট। হিপিদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রের 'ট্রেডমার্ক ড্রেডলক'।




আফ্রিকান ড্রেডলক: মায়ের গর্ভেই জটাধারী


দাদা। এ শব্দের অর্থ আর নতুন করে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু এই তথ্য জানলে অবাক হবেন, আফ্রিকাতে 'দাদা' তাঁদের বলা হয়, যে শিশুরা মায়ের গর্ভেই জটাধারী হয়। আফ্রিকাতে এমনও রীতি প্রচলিত আছে, যেখানে একজন স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর মানুষ অন্য কোনও স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলে, ড্রেডলকই হয় তাঁদের পরিচয়। আফ্রিকার মাসাই জাতি। এখন তাঁরা প্যাড-ব্যাট নিয়ে ক্রিকেটও খেলছে। সেই মাসাইদের অনেক স্বতন্ত্রতার মধ্যে একটি হল ড্রেডলক। আর বিশ্ব লোকপ্রিয়তায় জামাইকান ফেয়ারওয়েলের মতই জামাইকানদের আইডেনটিটি অবশ্যই তাঁদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেডলক।




চুল পড়া বন্ধ করতে ড্রেডলক!


আধুনিক সমাজের আধুনিক আবিষ্কার। মাথায় চুল একেবারেই অল্প। অনুর্বর জমিতে চাষ করলে 'অঙ্কুর হয়, ফল ফলে না', তাই চুল পড়া আটকাতে ড্রেডলকই হল আধুনিকতম চিকিৎসা। কানাডায় বিগত একদশক ধরে এই ভাবেই লোকপ্রিয়তা পেয়েছে ড্রেডলক।




বিশ্বের একমাত্র মহিলা, যার জটা সবথেকে বড়


২০১০, ১০ ডিসেম্বর। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে 'সর্ব বৃহৎ ড্রেডলক' ক্যাটাগরিতে জয়ী হয়েছিলেন একমাত্র মহিলা আশা ম্যান্ডেলা।