সুদীপ দে: শুক্রবার অফিস পাড়ায় একটা কাজে গিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে ফিরছি, এমন সময় চাঁদনিচকের একটি অফিসের বাইরে এক যুবককে ওই অফিসেরই নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, সাইকেল নিয়ে রাইডিং হেলমেট পরা ওই যুবকের বাঁ হাঁটুর নীচ থেকে নেই। অর্থাত্ বাঁ পা নেই। কৃত্তিম পায়ের সাহায্যে অবলীলায় দাঁড়িয়ে সেই যুবক কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করছেন ওই অফিসের নিরাপত্তারক্ষীদের। কৌতুহল হওয়ায় এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। যুবকটির পাশে দাঁড়ানোর পর যেটুকু কথা কানে এল তাতে বুঝলাম, ও সাহায্য চাইছে। না, টাকা পয়সার সাহায্য চাইছে না। বিনা পয়সায় একটু খাবার বা পানীয় জল চাইছে। আর যদি সম্ভব হয়, রাতটুকু কাটানোর জন্য একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কিন্তু তাঁর কেন এমন সাহায্য লাগবে? পায়ের এমন অবস্থায় সাইকেল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন এই যুবা? প্রশ্নটা করেই ফেললাম। উত্তরে তিনি বললেন, দূষণমুক্ত পরিবেশ আর পথনিরাপত্তার প্রচারে সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে সে। ইনদৌর থেকে যাত্রা শুরু করে দেশের বিভিন্ন শহর, গ্রাম ঘুরে দিল্লিতে শেষ হবে তার অভিযান। অবাক হয়ে গেলাম তার কথা শুনে! একটুও দেরি না করে নিজের মোবাইল নম্বরটা তাঁকে দিয়ে বললাম, "আমায়, তোমার এই অভিযানে অংশিদার করবে? তোমার কথা আমি জানতে চাই, জানাতে চাই হাজার হাজার মানুষকে।" হাসিমুখে রাজি হয়ে গেল ছেলেটি। তারপর থেকে ওর সফরসঙ্গী হয়েছি আমিও... ভয়েস আর ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে।



বছর ত্রিশের প্রদীপ কুমার মারাদওয়াল মধ্যপ্রধেশের ইনদৌরের বাসিন্দা। অভাবের সংসারে নিজের পড়ার খরচ জোগাতে দশ বছর বয়সেই মাসিক মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে সাইকেল সারানোর কাজে হাত লাগায় প্রদীপ। সংসার চালানোর জন্য কখনও রঙের কারখানায়, কখনও বা কোনও কল সেন্টারে কাজ করেছে সে। কিন্তু দারিদ্রকে কখনও নিজের স্বপ্নের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি সে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফাঁকে থিয়েটারে অভিনয়, আঁকা শেখা, গান...কিছুই বাদ দেয়নি প্রদীপ। ছেলের এমন বহুমুখী প্রতিভা দরিদ্র পরিবারে আশার আলো দেখায়। কিন্তু ২০১৩ সালের একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় বাঁ পা খোয়া যায় প্রদীপের। এরপরই দরিদ্র মারাদওয়াল পরিবার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভেঙে পড়ে। ছেলের কাঁধে ভর করে স্বচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্ন মুহূর্তে ভেঙেচুড়ে একাকার হয়ে যায়! কিন্তু দুর্ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দ্বিগুণ মনোবলে ভর করে তখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে বছর পঁচিশের প্রদীপ। শুরু হয় এক পায়ে একটু একটু করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। দেখতে দেখতে একদিন ওই এক পায়েই আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটতে শুরু করল প্রদীপ। আর আজ সেই প্রদীপ সাইকেলে চড়ে ৮,৮৫০ কিলোমিটার পেড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য ১৫,২২৩ কিলোমিটার অতিক্রম করে নতুন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড সৃষ্টি করা।



বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রদীপের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ যথেষ্ট প্রতিকূলতায় ভরা। কখনও রাস্তা এবড়ো খেবড়ো, তো কখনও আবার বিপদসংকুল জঙ্গলের বুক চিরে বেরিয়ে আসা নির্জনতায় মোড়া। স্পনসর হিসেবে প্রদীপ পেয়েছেন একটি সাইকেল, যেটিতে চড়ে বিশ্ব রেকর্ডের লক্ষ্যে এগোচ্ছে সে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে নিত্যদিনের থাকা-খাওয়ার খরচ কে দেবে তাঁকে! তাই এ ক্ষেত্রে প্রদীপের ভরসা দেশের পথচলতি সাধারণ মানুষ। কোথাও সাহায্য চেয়ে মিলেছে দুর্ব্যবহার, গলাধাক্কা, গালিগালাজ... কোথাও আবার মানুষ এগিয়ে এসেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কোনও ধাবায় বা হোটেলে বিনা পয়সায় খাবার জুটেছে, কখনও ঘণ্টা খানেক জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও মিলেছে। কেউ কেউ আবার যে যার সাধ্য মতো ৫-১০ টাকা দিয়েছেন প্রদীপকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সে তো অতি সামান্যই! সাহায্যের প্রয়োজন তাঁর। কিন্তু কী ভাবে তা মিলবে, জানা নেই প্রদীপের। তবু এগিয়ে চলেছে...।



রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই না মিললে, সারা রাত সাইকেল চালাতে হয়... যতটা এগিয়ে থাকা যায় এ ভাবে। সময় নষ্ট করলে তো চলবে না! ১৪ নভেম্বর, ২০১৭-এ ইনদৌর থেকে যাত্রা শুরু করেছে সে, দিল্লিতে ১৫ জুন শেষ হবে এই অভিযান। ১৮ জুন ঘরে ফিরবে ঘরের ছেলে। কিন্তু দিন বদলের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানা নেই প্রদীপের। কিন্তু আর্থিক হোক বা শারীরিক... কোনও রকম প্রতিবন্ধকতার কাছে সে হার মানতে নারাজ! তাই ঘরে ফিরে দিন গুজারনের চেষ্টার পাশাপাশি গৃহহীন, সন্তান পরিত্যক্ত বৃদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় সে। সাহায্যের প্রয়োজনে আরও একটা কঠিন অভিযানে যেতে সে প্রস্তুত। এই অভিযানে ক’জনকে পাশে পায় প্রদীপ, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা...