সুবীর ভট্টাচার্য্য


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

মহালয়া অমাবস্যার পূণ্য তিথিতে নদী মাতৃক দেশ ভারত ভূমির নদীর দু’কূলের ঘাটে ঘাটে, বিভিন্ন জলাশয়ের তীরে করজোরে উত্তর পুরুষগণ আহ্বান করেন তাঁদের পূর্ব পুরুষগণকে- “আগচ্ছন্তু মে পিতর ইমং গৃহ্ন স্ত্বপোঞ্জলিম”, অর্থাত্ হে পিতৃপুরুষগণ আপনারা আসুন আমার জলাঞ্জলী গ্রহণ করুন। স্মরণাতীত কাল থেকে মহালয়ার তর্পণ চলে আসছে হিন্দু সংস্কৃতিতে। দেবীপক্ষের শারদীয় আনন্দ উত্সবে মাতোয়ারা হওয়ার প্রাক্কালে হিন্দুগণ বিশ্বাস করেন, তাঁদের পূর্বজ পিতৃপুরুষগণও আবির্ভূত হন ধরাধামে। উত্সব শেষে তাঁরা ফিরে যান পিতৃলোকে। এ সময় আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তাঁদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার প্রথাও প্রচলিত আমাদের বাংলাদেশে। তাই, তাঁদের উদ্দেশে তর্পণ, জল দান দ্বারা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। এ তো গেল বিশ্বাসের কথা। প্রকৃত পক্ষে তর্পণ হল স্মৃতির কাছে নতজানু হওয়া। যে পূর্বপুরুষগণ বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত থাকেন, আমাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখে যাঁদের শরীরি উপস্থিতি নেই, তবুও তাঁরা আছেন। দেবীপক্ষের শুভারম্ভে চারিদিক যখন মুখরিত হচ্ছে দেবীর আবাহনী বন্দনায়, সেই লগ্নে তাঁদের স্মরণ ও স্মৃতি তর্পণের মধ্যে দিয়ে উত্তর পুরুষগণ এক মানবিক ঔদার্যের পরিচয় দেন। ইতিহাসের প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি, আজকে আমি হয়ে ওঠার পিছনে যে প্রবাহমান অতীত রয়েছে ‘পিতৃ তর্পণ’ সেই অতীতকে স্বীকৃতি দানের এক উপায় মাত্র।


তর্পণ প্রথা হিন্দুদের কাছে এক শাস্ত্রীয় নির্দেশও- “নাস্তিক্য ভাবাত্ যশ্চাপি ন তর্পয়তি বৈ সুতঃ, পিবন্তি দেহ রুধিরং পিতরো বৈ জলার্থিনঃ।।” অর্থাত্, নাস্তিক ভাবধারায় যে সন্তান তর্পণ করেন না। জল পানের আশায় পিতৃপুরুষগণ তাঁর কাছে আসেন এবং নিরাশ হয়ে রক্ত পান করে চলে যান।


আরও পড়ুন- মহালয়াতে চোখ লেখার রীতি ভাঙছে কুমারটুলি


‘বসুধাইভা কুটুম্বকম’ অর্থাত্ এই বিশ্বের সকল প্রাণই আমার আত্মীয়- এই ঋষি বাক্যই ধ্বনীত হয়েছে লক্ষ্মণ তর্পণে-“আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং জগত্তৃপ্যতু”। রাম তর্পণেও সেই একই সুর ধ্বনীত হয়েছে- “অতীত কূলকোটিনাং সপ্তদ্বীপ নিবাসিনাম, ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্ত ভূবনত্রয়ম্”। অর্থাত্, সেই বিগত অতীত থেকে আজ পর্যন্ত এই সপ্তদ্বীপের সমাহার ভারত ভূমির সকলেই তৃপ্ত হোক আমার প্রদত্ত এই জলের দ্বারা।


পুত্র সন্তানের প্রতি তাঁর মাতা-পিতা এবং পূর্বপুরুষগণের অনন্ত চাহিদা। নরক থেকে ত্রাণ করেন বলেই তো তিনি পুত্র। কিন্তু মহাভারত মহাকাব্যের পিতামহ ভীষ্ম বিবাহ করেননি। ফলে তিনি অপুত্রক। এই ভারতে ভীষ্মের মতো কোটি কোটি পুরুষ রয়েছেন যাঁরা পুত্রের পিতা হননি। সেই পুরুষদের অতৃপ্ত আত্মার প্রতিও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে তর্পণ ক্রিয়া- “অপুত্রায় দদাম্যেতত্ সলিলং ভীষ্মবর্ম্মণে।।” বন্ধু, আত্মীয় না হয়েও, রক্তের সম্পর্কীত না হয়েও যিনি পরমাত্মীয়। শুধু এই জীবনে নয়, জন্ম জন্মান্তর ধরে সেই সমস্ত বন্ধু বা বন্ধুভাবাপন্নদের উদ্দেশেও তিল তর্পণের নির্দেশ রয়েছে শাস্ত্রে- “যে বান্ধবা বান্ধবা বা যেন্য জন্মনি বান্ধবাঃ...।।” তর্পণকালে পিতা-মাতা ছাড়াও সপ্ত পুরুষগণকে জল দানের নির্দেশও দিয়েছেন শাস্ত্রকারগণ।


আরও পড়ুন- রেডিও ধার্মিক মীরের কাছে মহীষাসুরমর্দিনী আজও গাইডবুক


এই উপলক্ষে বছরের এই একটি দিন উর্দ্ধতন সেই সমস্ত পুরুষগণের নাম ও তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক উল্লেখ করতে হয়। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের নিজেকে সংযুক্ত করার সময় তর্পণকারীর শরীর ও মনের মধ্যে যে অনুরণন হয় তার মূল্য তাই অসীম। তর্পণকারী অনুভব করতে পারেন তাঁর অস্তিত্ব। তিনি কোনও ছিন্নমূল নন। তাঁর রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই আইডেনটিটি ক্রাইসিসের ঝোড়ো হাওয়ার যুগে তর্পণ এক প্রত্যয়ী প্রত্যয়।