পূর্ণ শশী, চিরস্মরণীয় জীবন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কতটুকুই বা আবিষ্কার করতে পেরেছে ভারতীয় ছবি? সদ্যযুবা থেকে শেষ বয়সের পৃথুল শশী, গোটা জীবনটাই যেন মহাকাব্য। লিখেছেন শর্মিলা মাইতি


শশী কাপুর: দ্য হাউজহোল্ডার, দ্য স্টার


লেখক: অসীম ছাবরা


প্রকাশক: রূপা


নিজের প্রিয় নৌকোটি টেনে এনে বের করেছিলেন শশী। দীর্ঘ রোগভোগের পর ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেছেন স্ত্রী জেনিফার। মৃত্যুর আগে একটি ছোট্ট অনুরোধ রেখেছিলেন তিনি। প্লিজ শাট দ্য শপ। দুঃখের বোঝা আর না বাড়িয়ে বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন শশীর প্রোডাকশন হাউজ। কিন্তু শেষের সেদিন সবকিছুর প্রয়োচজন ফুরিয়েছিল। পুত্র কুণাল কাপুরের কথায়, তিনি নিজেই নৌকো বেয়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর মাঝসমুদ্রে। হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন সেই প্রকাণ্ড নির্জনতায়।


জীবনে কোনওদিনও শেষ হওয়ার আশঙ্কায় শেষ হননি শশী কাপুর। প্রযোজক হওয়ার প্রথম দিন থেকেই এক অপার উদারতা লালন করেছিলেন মনেপ্রাণে, যা মোটেই প্রযোজক-সুলভ নয়। অপর্ণা সেনের প্রথম ছবি থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন প্রযোজনার দায়িত্ব নেন তিনিই। বম্বে টকিজ এ আর ইমান ধরম-এ একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁরা। সেই বন্ধুত্বের দায়িত্ব নিয়েই প্রযোজনা করতে রাজি হন। মুম্বইয়ের বাড়িতে ডেকে গোবিন্দ নিহালনি ও স্ত্রী জেনিফারের সঙ্গে একদিনেই স্ক্রিপ্ট শোনেন নিজের বাড়িতে বসে। পছন্দ হতেই রাজি হয়ে যান। ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছিল ক্লাসিক ছবি থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন। সিনেমার স্বাদগন্ধ আরও বেশি করে আহরণের জন্যেই যেন ছিল তাঁর প্রযোজনায় আসা। ভাল লাগলে এক কথায় রাজি।


এই উদারতা কী এসেছিল কাপুর পরিবারের সহনশীলতার অনুশীলন থেকেই। যা প্রবহমান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ময়। অসিধারের মতো ধীশক্তি। ছোট ভাইকে রাজ সকালপুরই এনেছিলেন। সদাহাস্যময়, সদ্যযুবা। যাঁর চোখের পাতার প্রশংসা করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, নারকেল পাতার মতো বড় আর গভীর। প্রথম ছবি ধরমপুত্র সাফল্য পায় নি। কিন্তু শশী-শর্মিলা জুটিকে দর্শক নিয়েছিল। আমনে সামনে, সুহানা সফর, আ গলে লগ যা থেকে শুরু করে শশী কাপুরের একমাত্র জাতীয়পুরস্কারের ছবি নিউ দিল্লি টাইমস, সবেতেই শর্মিলা ছিলেন তাঁর যোগ্য সঙ্গী।


শর্মিলার সঙ্গে এক অনবদ্য বন্ধুত্ব হয়েছিল শশীর। তখন টাইগার পতৌদির সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়ার পর্ব চলছে শর্মিলার। বিদায়ের সময়ে শর্মিলা বলতেন, খুদা হাফিজ। বলছেন শর্মিলা: শশী আমার পেছনে লাগতেন, বলতেন, “Half is his, half is mine”. ওঁর জন্যে মনের নরম জায়গাটা সব সময়ে ধরা থাকত।


লেখক অসীম ছাবরার গবেষণার ধরণ ও গল্প লেখার কায়দা, দুটোই সুন্দর, স্বচ্ছন্দ। শশী কাপুর যে বিদেশি ছবির আঙিনায় ভারতের প্রথম সফল, সুপুরুষ মুখ, সেটা অসীমের লেখায় পূর্ণরূপে ব্যক্ত। শশীর যেটুকু আমরা হিন্দি ছবিতে পাই, তা যথেষ্ট নয় বললেও কমই বলা হয়। আনন্দ ছবিতে রাজেশ খন্নার বহু আগেই শশী কাপুরের সঙ্গে ফাইনাল কথাবার্তা হয়েই গিয়েছিল। পরে যে হৃষীকেশমশাই তাঁর নায়ক পরিবর্তন করেছেন, সে কথা শশীর কানে এসেছিল অন্যভাবে। নাঃ, কিছুই মনে করেননি শশী। উদারতা আর সভ্যতাজ্ঞান, দুটোরই অনবদ্য এক মিশেল ছিল তাঁর মননে। কাছের মানুষ ছাড়া কেউই জানত না।


আসি ছবির প্রচ্ছদে। হিট অ্যান্ড ডাস্ট ছবির সেই রাজকুমার, কেন স্বভাবসিদ্ধ হাসিমুখের ছবি নয়। একটা অনির্বচনীয় গাম্ভীর্য, আভিজাত্য যা আসলে শশীর পুরো জীবনের বর্ণনা। খুব কঠিন এই সহজ করে পৌঁছে দেওয়াটা। পেরেছেন দূরদর্শী প্রকাশক।


ইসমাইল মার্চেন্ট ও জেমস আইভরির মার্চে ন্ট আইভরি প্রোডাকশনের প্রায় সিংহভাগই অসম্পূর্ণ থেকে যেতে শশীর ছোঁয়া ছাড়া। ১৯৭০ সালের বন্বে টকিজ, মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশনের তৃতীয় ছবি। টাইপরাইটারের উপর শশী কাপুর-হেলেনের উদ্দাম নৃত্য। প্রতি দৃশ্যেই চেষ্টা ছিল দর্শকমোহনের সব মশলার। শশীর জীবনের অন্যতম সেরা বন্ধু অমিতাভ বচ্চন তখন একটি দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। কারণ ছিল, পঞ্চাশ টাকার দৈনিক বেতনটুকু! ১৯৭৬ সালে সিদ্ধার্থ। এই প্রোডাকশনের আর এক ল্যান্ডমার্ক ছবি। উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গের সিমি গাঢ়েওয়ালের সঙ্গে অন্তরঙ্গ শশীকে নিয়ে উঠেছিল তুমূল বিতর্ক। কিন্তু ছবির গভীরতাই ছুঁয়ে গেল সারা পৃথিবীর দর্শককে।


কিন্তু পপুলার সিনেমা কতটুকুই বা উন্মোচন করেছিল শশীর? কী পেয়েছিলেন তিনি, মেরে পাস মা হ্যায় বলে? অমিতাভের পাশে শশী। প্রিমিয়ারে। স্ক্রিন জুড়ে সেই বিখ্যাত সংলাপ, সম্ভবত সংলাপের ইতিহাসের সেরা সেই সংলাপ, শুরু হতেই শশী হাত রাখলেন অমিতাভের হাতের উপর। ঘন অন্ধকারে দুই সহৃদয় বন্ধুর সেই আন্তরিকতা। পাশে আছি, পাশে থাকব... যে বন্ধুত্ব বাড়তে বাড়তে একদিন আকাশ ছুঁয়ে যায়। নাচে-গানে-পানে তাঁরা ছিলেন ইয়ারদোস্ত, জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ছিলেন সোলমেটস।


যে মানুষটা শ্যাম বেনেগলের জুনুন থেকে কলিযুগ, কোনও নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতেই বুক চিতিয়ে এগিয়ে যান, সেই উদ্ধত মানুষটিকে দর্শক আসলে কী দিল? যিনি ১৯৮৩ সালের উত্সবের সমস্থানকের চরিত্রে নিজেকে বসানোর জন্য প্রচুর ওজন বাড়িয়ে ফেলেন, আবার ঝরিয়ে ফেলেন পরের ছবির জন্য, তিনি তো আধুনিক হতেই এসেছেন। কতটুকু জানতাম আমরা স্যামি অ্যান্ড রোজি গেট লেড-এর রফিকে? কতটুকুই বা জানি, মঞ্চের শশী কেমন ছিলেন? এ বইয়ের পাতায় পাতায় মোড়া রহস্য। কখনও গলার কাছে আটকে আসা দলা-পাকানো দুঃখ, কখনও পাঠকের নিজের কাছেই কৈফিয়ত চাওয়া। এ বই হবে দর্শকের স্মৃতির লাইব্রেরিতে সেরা বইয়ের একটি। লালমলাটের বাঁধাই, যেন চিরায়তের সিলমোহর। এ বই পেপারব্যাকের তাকে হারিয়ে যেতে আসেনি। রাখতে এসেছে ঐতিহ্য। অস্তিত্ব।


হঠাত্ যেন মনে পড়ায় সিলসিলা ছবিতে শশীর সেই চিরস্মরণীয় সংলাপ: হম গায়েব হোনেওয়ালোঁ মে সে নেহি হ্যায়। জাঁহা জাঁহা সে গুজরতে হ্যায় জলওয়ে দিখাতে হ্যায়। দোস্ত তো ক্যায়া, দুশমন ভি ইয়াদ রখতে হ্যায়। ‍