সংখ্যালঘু ইন্দিরার ‘ব্যাকবোন’! ৩ সাংসদ নিয়েও ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ প্রণব
অনির্বাণ সিনহা
অনির্বাণ সিনহা
১৯৬৯। রাজ্যসভার অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরনোর পথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পথ আগলে দাঁড়ালেন সিপিআই সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত। সঙ্গে ধুতি-পঞ্জাবি পরা বেঁটে-খাটো এক যুবক। বন্ধু ইন্দিরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আজ এর বক্তব্য শুনেছো তো? কেমন লাগলো তোমার?'
মুচকি হেসে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর ছিল, 'অফ কোর্স। হি স্পোক ভেরি ওয়েল।' ব্যস্। শুরু হয়ে গেল, পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দী জুড়ে ভারতীয় রাজনীতির সেরা ক্রাইসিস ম্যানেজার এর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। সে দিন রাজ্যসভায় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ নিয়ে যখন বলতে উঠছেন, তখন খর্বকায় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে পিছনের বেঞ্চ থেকে সামনের সারিতে ডেকে এনেছিলেন, ডেপুটি চেয়ারম্যান স্বয়ং। কিছুটা রসিকতার ছলেই বলেছিলেন, 'তুমি সামনে এসে না বললে, সব সদস্য তোমায় দেখতে পাবেন না।'
এমনিতেই আলোচনা ও বিতর্কের গুরুত্বের কারণে হাউস সে দিন টইটুম্বুর। কাকতালীয় ভাবে তখনই সভায় ঢুকলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা কংগ্রেসের এক তরুণ সাংসদ তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে বক্তব্য পেশ করছেন দেখে ,মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকেন ইন্দিরা। তারপরই বেরনোর সময়, বন্ধু ভূপেশের কাছে এমন প্রশংসা। কিছুদিন পর, আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল প্রণবের জন্য। হঠাত্ প্রধানমন্ত্রীর তলব। দুরু দুরু বুকে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটির সামনে গিয়ে বসতেই আরও অবাক হওয়ার পালা। ইন্দিরা জানালেন অত্যন্ত গোপন একটি বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি প্রণবকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তখনও দিল্লির শীত না কাটানো, কীর্ণাহারের যুবক আকাশ-পাতাল ভাবতে বসলেন। কংগ্রেস ভেঙে তৈরি বাংলা কংগ্রেসের প্রথমবারের রাজ্যসভার সাংসদ, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে কোন গোপন কথা বলতে পারেন দেশের প্রধানমন্ত্রী? বিশেষত, রাজ্যসভায় তাঁর দলের সাংসদ সংখ্যা যেখানে কমতে কমতে ৩-এ এসে ঠেকেছে!
বামেদের সঙ্গে দু-দুবার যুক্তফ্রন্ট সরকার চালানোর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর বাংলা কংগ্রেসে তখন নব কংগ্রেসে ঘর ওয়াপসির হাওয়া। হারাধনের শেষ তিনটি ছেলের মত টিকে আছেন, সুশীল ধাড়া, সর্দার আমজাদ আলি ও নবাগত প্রণব মুখোপাধ্যায়। এর মধ্যে সুশীল ধাড়াকে নিয়ে ইন্দিরার কোনও সংশয় নেই। কিন্তু, প্রণবেরই সতীর্থ আমজাদ আলিকে নিয়ে তিনি সন্দিহান। আইবি সূত্রে তিনি খবর পেয়েছেন, আমজাদের সাংসদ বাংলোয় আজকাল রাজা-রানিদের ভিড় লেগে থাকে। আর তাতেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ। শিগগিরি তিনি রাজন্যভাতা বিলোপের বিল আনতে চলেছেন। সংসদের দুই কক্ষেই প্রতিটি ভোট তাঁর কাছে এখন মূল্যবান।
আরও পড়ুন- প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, ফিরে দেখা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পাঁচ দশক
এই পরিস্থিতিতে প্রণবের কাছে তাঁর দাবি, আমজাদের ভোট যাতে তাঁর পক্ষেই পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রণবকে। প্রণব মুখোপাধ্যায় সে দিন কথা দিয়ে এসেছিলেন, তাঁর বাংলোয় যাঁরাই যাতায়াত করুন, আমজাদ আলি ভোট দেবেন ইন্দিরার প্রস্তাবের পক্ষেই। অভিন্ন হৃদয় আমজাদের সঙ্গে কথা না বলেই প্রণবের এই কথা দেওয়ায় অবাক হলেও, ভরসা করেন ইন্দিরা। ভরসার অমর্যাদা করেননি প্রণব। তিনি আসলে জানতেন, রাজা-রানিরা যতই চেষ্টা করুন, বাড়িতে যতই যান, আমজাদ তাঁর দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন না। আর ঠিক তাই হয়েছিল।
আমজাদ আলি সরকারি প্রস্তাবেই ভোট দেন। শুধু তাই নয়, বছর তিনেক পর আমজাদকে সঙ্গে নিয়েই কংগ্রেসে যোগ দেন প্রণব। অসম্ভব বাগ্মী আমজাদ আলি অচিরেই হয়ে ওঠেন, ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম প্রিয় পাত্র। সে সব অবশ্য আরও পরের কথা। কিন্তু, সেই ১৯৬৯ থেকেই বাংলা কংগ্রেসের সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন সংসদে সংখ্যালঘু ইন্দিরা গান্ধীর বিপদের বন্ধু। ক্রাইসিস ম্যানেজার। কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ইউএসপি।