নিজস্ব প্রতিবেদন: আরব সাগর দিয়ে এরমধ্যে বয়ে গিয়েছে অনেকটা জল। 'বালাসাহেব-বাজপেয়ী-আডবানী'র সেই দিন আর নেই। মহারাষ্ট্রে সেনার যে আর সেই দাপট নেই, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ভোটের 'পার্টি গণিত'। কিন্তু, কিছুতেই এই বাস্তবতা মেনে নিতে চাইছে না উদ্ধব ঠাকরের দল। এমনটাই অভিযোগ বিজেপির।   


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

বিজেপির এক ক্যাবিনেট সদস্যের কথায়, অমিত শাহ-উদ্ধব ঠাকরের বুধবারের বৈঠকেই লোকসভা নির্বাচনে একসঙ্গে লড়ার বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিল বিজেপি ও শিবসেনা। কিন্তু, আসন্ন মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে আসন রফা নিয়ে মাতশ্রী-র সংখ্যা গরিষ্ঠ সহমত নয়। আর তাই কথা বাড়াননি অমিত শাহ।


এমনিতে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়কার অসন রফা মেনে নিতে আপত্তি নেই কোনও পক্ষেরই। সেসময় মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি ও শিবসেনা লড়েছিল যথাক্রমে ২৬ ও ২২ আসনে। কিন্তু, গোল বাধে রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা ভোটের (২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক দুই মাসের মধ্যে বিধানসভা ভোট হবে) আসন রফা নিয়েই। শিবসেনা চায় রাজ্যের মোট ২৮৮ বিধানসভা আসন নিয়েই আলোচনা হোক। কিন্তু বিজেপির বক্তব্য, গত বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনুসারে যে ১০৩টি আসনে বিজেপি বা শিবসেনা কেউ-ই জেতেনি, শুধু সেগুলি নিয়েই ভাগাভাগির আলোচনা হোক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে নিজেকে এখনও মহারাষ্ট্রে এনডিএ জোটের 'বড় ভাই' বলে মনে করা শিবসেনা, পদ্ম শিবিরের এই সূত্রে অরাজি। আর সেখান থেকেই মাতশ্রীতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক মুলতুবি হয়ে যায় বুধবার। আপাতত রণে ভঙ্গ দেন অমিত শাহও।


কিন্তু, কেন এমন দাবি করছে বিজেপি? শিবসেনার-ই বা বক্তব্য কী? সাম্প্রতিক অতীতের ভোটের 'পার্টি গণিত' কী বলছে?


২০১৪ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের আগে বহুচেষ্টার পরও বিজেপি-শিবসেনা জোট অধরাই থেকে গিয়েছিল। ফলে, পৃথকভাবে লড়ে এই দুই দল। সেই ভোটে ২৬০টি আসনে লড়ে বিজেপি জিতেছিল ১২২টিতে, আর ২৮২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শিবসেনার কপালে জুটেছিল মাত্র ৬৩টি। বিজেপি সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসাবে উঠে এলেও, সরকার গড়ার মতো ম্যাজিক ফিগার ছিল না তাদের কাছে। এমতাবস্থায় চিরসঙ্গী শিবসেনার সঙ্গে নির্বাচন উত্তর জোট করে রাজ্যে সরকার গড়ে তারা। মুখ্যমন্ত্রী হন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ। এরপর থেকে নানা ইস্যুতে বিজেপির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে উদ্ধবের দল। দুই জোটসঙ্গীর সম্পর্ক দিনকেদিন খারাপ হতে হতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়েছে যে, রাজ্যের বেশ কিছু আঞ্চলিক নির্বাচনে ফের পৃথকভাবে লড়েছে এই দুই দল। এমনকি, শিবসেনা ইতিমধ্যে ঘোষণাও করে দিয়েছে, আগামী দিনে কখনও বিজেপির সঙ্গে জোটে যাবে না তারা। আরও পড়ুন- "প্রণবের উপদেশ গ্রহণ করুক আরএসএস"


কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস একটা অ-বিজেপি জোটের সলতে পাকানোর চেষ্টা করছে এবং দিকে দিকে উপ-নির্বাচনে আশঙ্কাজনক ফলাফল করে হারতে হচ্ছে বিজেপিকে। এরসঙ্গে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো, নীতীশ কুমার বেগড়বাই করছেন। ফলে, কংগ্রেসের কাছে জোটসঙ্গীদের ধরে রাখাটাই একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। তাই প্রত্যাশিতভাবেই বড় শরিকের দায়বদ্ধতা অনুযায়ী শিবসেনার সঙ্গে আলোচনা করে বিরোধ মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ। কিন্তু, তা বলে নিজেদের 'হকের দাবি' বিজেপি কোনও কারণেই হাতছাড়া করতে চায় না।


২০১৪ সালে ২৮৮ আসন বিশিষ্ট মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি (১২২) ও শিবসেনার (৬৩) মোট জয়ী আসনের সংখ্যা ১৮৫। ফলে, ১০৩টি আসনে এই দুই দলের কেউই জেতেনি। বিজেপি নেতৃত্ব এখন শুধু ওই ১০৩টি আসনের রফা নিয়েই আলোচনা চাইছে। পাশাপাশি বিজেপি এও জানাচ্ছে, যে ১২২ আসনে গত নির্বাচনে জয় পাওয়া গেছে, সেই আসনগুলি আগামী নির্বাচনেও কিছুতেই ছাড়বে না তারা। কিন্তু, বিজেপির এই কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না একদা মহারাষ্ট্রের 'বড় ভাই' শিবসেনা।


২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে দুই দলের প্রাক নির্বাচনী জোট না হলেও, তার আগে পর্যন্ত একই সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে আদর্শগত দিক থেকে সতীর্থ বিজেপি ও আরএসএস। বালঠাকরে-বাজপেয়ী-আদবানী জমানায় সেসময় সেনা লড়েছিল ১৭১ আসনে এবং বিজেপি পেয়েছিল ১১৭টি আসন। যে দল বেশি আসন জিতবে, তারাই মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হবে, এমনটাই রফা হয়েছিল দুই তরফে। এরপর ১৯৯৫ সালে সেই রফা মেনে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হন শিবসেনার মনোহর যোশী।


কিন্তু, ২০১৪ সালে দেবেন্দ্র ফড়নবীশ রাজ্যের তখতে বসার পর পৌর ও জেলা পরিষদের একাধিক ভোটে শুধু জয়েরই মুখ দেখেছে পদ্ম ব্রিগেড। ফলে, পরিস্থিতি যে অনেকটাই পাল্টেছে। এই পরিবর্তীত সমাকরণ 'এককালের বড় শরিক' শিবসেনাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছে বর্তমানে 'বড় ভাই' হয়ে ওঠা বিজেপি। কিন্তু, অনড় শিবসেনা, বিজেপির এই তত্ত্ব কিছুতেই মানতে নারাজ। এদিকে বিজেপি আবার সেনাকে বলেছে, যদি তাদের জোট ভেঙে যায়, তাহলে কংগ্রেস ও এনসিপি হাত মেলাবে। আর সেক্ষেত্রে ২০১৯ সালে রাজ্যের ক্ষমতা বর্তমান বিরোধীদের হাতে চলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, একথাতেও মন গলেনি শিবসেনার। আর এরপরই আলোচনা থামিয়ে দেন বিজেপি সভাপতি শাহ। কিন্তু, তাহলে কি হাল ছেড়ে চরম সিদ্ধান্তের দিকেই এগোচ্ছে বিজেপি?


বিজেপির ওই ক্যাবিনেট সদস্য বলছেন, কখনও না। কেন্দ্রের শাসক তথা বড় শরিকের সাংগঠনিক প্রধান হিসাবে কোনও 'বাজে অহংবোধ' নেই শাহর। বরং, ঐক্যমত্য তৈরি করতে তিনি একাধিকবার আলোচনায় বসতে উত্সাহী। আর এখানেই উভয় পক্ষের রাজনৈতিক স্বার্থ জনিত বাধ্যবাধকতার কথা বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। বিজেপির সঙ্গে জোটে না গেলে শিবসেনা যে একা কিছুই করতে পারবে না, বরং রাজ্য রাজনীতিতে আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে তা নিশ্চিত। আবার ধর্মনিরপেক্ষ অ-বিজেপি জোটেও 'হিন্দুত্ববাদী' শিবসেনা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। ফলে, বিজেপিকে তাদের দরকার। আর অন্যদিকে, কর্ণাটক হারিয়ে ও দেশে জুড়ে উপনির্বাচনে হেরে আক্ষরিক অর্থেই বড় বিপদের আশঙ্কায় বিজেপি। ফলে, এই দুই দলকে 'পারস্পরিক স্বার্থে' কাছে আসতেই হবে, শুধু যতটা সম্ভব সম্মান বজায় রেখে ফেরা যায় তার জন্য সময়ের অপেক্ষা।