৯৩-এর ভিএস বনাম ২৯-এর ভিএস, সিপিএমের `শেষ নক্ষত্রে`র সঙ্গে লড়াই এক উল্কার
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে 'চিরলাল' এক নাম। 'লাল'দের কাকাবাবুর (মুজফফর আহমেদ) হাত ধরে ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর লাল পার্টির লাল ঝান্ডা ভারতে প্রথম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রাম আর হাজার হাজার শহিদের মাইল ফলক পেরিয়ে দল এগিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়ের ফুটন্ত রক্তের টগবগে যুবকদের মতই কেরালার এক কৃষ্ণবর্ণ যুবক কমিউনিস্টদের 'হতচ্ছাড়া' পার্টির মিছিলে যোগ দিয়েছিল। নাম তাঁর ভিএস অচ্যুতানন্দন। সেই শুরু। তারপর আর ফিরে দেখা নয়। জীবনের ৯৩ বসন্ত পেরিয়ে ভিএস আগেও যা ছিলেন, এখনও তাই, 'কিংবদন্তি কমিউনিস্ট'। দল ভাগ হল। ১৯৬৪ সাল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেড়িয়ে এসে নবরত্নের যুক্তিবোধে তৈরি হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)। হরকিষণ সিং সুরজিৎ, ওয়াই এস নম্বুদরিপাদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর সঙ্গে মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে, এলেন ভিএস অচ্যুতানন্দন। দলের চড়াই উতরাই যাই হোক, একনিষ্ঠ কর্মী আর জননেতা ভিএস হেঁটেছেন নিরলস বামপন্থার কণ্টকময় পথ। রাজনীতির অবসরে ভিএস বিশ্বাসীই নন। ওয়াঘা সীমান্তে বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যু নয়, ললাটে বীরগতি নিয়ে যাদের প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে জীবন কাটে ভিএস অচ্যুতানন্দন তাঁদের 'আদি পিতা'। রাজনীতির হাতেখড়িতেই লড়েছেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, স্বধীনতা দেখেছেন, দেখেছেন ৭৫'র কালো দিন, রাষ্ট্রপতি শাসন। ভিএস অচ্যুতানন্দন আজও লড়ছেন ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
আসন্ন কেরালার নির্বাচনে ভিএস অচ্যুতানন্দন কাস্তে হাতুড়ি তারা চিহ্ন আর লাল ঝান্ডা নিয়ে লড়বেন মালামপুহা কেন্দ্র থেকে। কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও সহাবস্থান নয়। খাতায় কলমে লড়াই কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই। ৯৩ বছরের ভিএস লড়বেন ২৯ বছরের ভিসের বিরুদ্ধে। কেরালায় কোনও সঙ্গোপন নয়, নয় কোনও 'মালাবদল'। মালামপুহা কেন্দ্রে কংগ্রেসে প্রার্থী ২৯ বছর বয়সী ভিএস জয়। জয়ের জয়-হারের বিচার হবে ভোটের ব্যালটে, তবে এক ভিএস মন জয় করে নিয়েছেন অন্য ভিএসের। বাংলার রাজনীতি যখন হাত বদল আর কংগ্রেসের গলায় সিপিএমের উত্তরীয় উড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত, তখন কেরালা যেন রুদ্ধদ্বার, অবরুদ্ধ কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে কংগ্রেসের জন্য। তবে বিরোধীদের থেকে কিংবদন্তির জন্য বিনম্র প্রণাম আর লক্ষ লক্ষ গোলাপ শুভেচ্ছা রয়েছে সবসময়ই। পাল্টা সৌহার্দ্য দেখিয়েছেন ভিস অচ্যুতানন্দনও। 'লড়াই যখন হবেই, তবে মানবিক ভাবেই হোক'।
হ্যাটট্রিক হয়েছে ২০১১ তেই। এবার চতুর্থবারের জন্য কেরলার বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন অচ্যুতানন্দন। যতদিন যাচ্ছে, অচ্যুতানন্দনের ডালিতে কোল উজাড় করে ভোট দিয়েছে মানুষ।
পরিসংখ্যানে চোখ বোলান-
২০০১ বিধানসভা নির্বাচন। ভিএস অচ্যুতানন্দন জয়ী ৪ হাজার ৭০৩ ভোটে।
২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের ব্যবধান এক লাফে ২০ হাজার। জয়ী ভিএস অচ্যুতানন্দন।
২০১১ বিধানসভা নির্বাচন। ভিএস অচ্যুতানন্দন জিতেছিলেন ২৩ হাজার ৪৪০ ভোটে।
কেরালার একসময়ের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী, দলের সর্বোচ্চ স্তর পলিটবুরো, সব স্থান থেকে নিজেই নেমে এসেছেন, এখন কেরালার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তবে তাঁর পরিচয় শুধুই কমিটি দিয়ে বাঁধলে ভুল হবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-ও এই ভুল কখনও করেনি। করবেই বা কী করে! নক্ষত্র যে গতিপথে ঘূর্ণায়মান সেই চক্রব্যূহে অভিমন্যু হয়ে ঢোকে এমন সাধ্যি কার? নীল আকশে মহাকাশের হাজার তারার মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন সবথেকে বেশি চোখে পড়ে আর মনে ধরে, ভারতের রাজবনীতিতে কমিউনিস্ট বৃত্তে ভিএস অচ্যুতানন্দনও তাই। উল্কারা খসেই পড়ে, নক্ষত্ররাই থেকে যায়।