হিমাচলের পাহাড় থেকে হরিয়ানার মালভূমিতে টেক অফ। মহেশের গাড়ি আর এগোবে না। হিমাচলের বর্ডার থেকে মহেশ টাটা ইন্ডিকা নিয়ে ফিরে যাবে সিমলা। পথে মানালি, মান্ডি পেরিয়ে হিমালয়ের রাজধানীতে ফিরবে সে। আমাদের ফিরতে হবে নিচে। আরও নিচে। হরিয়ানা, কালকা থেকে কলকাতা। মাথায় পাগড়ি, গাত্রে সাদা বসন, গালে রবি ঠাঁকুরের মত দাড়ি, মুখে চামড়ার ভাঁজগুলো যেন বটবৃক্ষের মূল। কানে একটু খাটো (খুব কাছ থেকে বলতে হয়, জোরে না বললে শুনতে পান না)। নাম না জানা সর্দারজির মারুতি ভ্যানে চেপেই সওয়ার আমি এবং আমরা। গন্তব্য, প্রথমে পিঞ্জোর গার্ডেন তারপর ব্যাক টু কালকা, কালকা স্টেশন। পাণ্ডব নাম থেকেই পিঞ্জোর শহরের নামকরণ। মাইথোলজির পাতায়, আর পিঞ্জোরবাসীর মুখে যেটা মিথ, 'মহাভারতের পঞ্চ পাণ্ডব বনবিহারে এসেছিলেন এখানেই। দ্য গ্রেট হিমালয়ান জার্নিতে অবিভক্ত পাঞ্জাবই ছিল যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, সহদেব ও নকুলের বিচরণ ক্ষেত্র'। মহাকাব্য আর বিশ্বাস দুইয়ের মেলবন্ধনে হরিয়ানায় এটাই 'বড় সত্যি'।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ। ভারতের দুই ভাই ভাই রাজ্য। বলা চলে এক মায়ের সন্তান। ১৯৬০ সালে ভাগাভাগিতে দুইয়ের ভৌগলিক মানচিত্রের ভাগাভাগি। দেহ থেকে ধর, সব কাটাছেরার মধ্যেও হৃদপিণ্ড থেকে গেছে অভিন্ন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে ভাগাভাগির প্রশ্ন না থাকলেও স্বাধীনতাই প্রথম দেশভাগের ইতিহাস রচনা করে দিয়ে গেছে-একথা সত্যি। স্বতন্ত্র ভারত গড়ার নামে ভূখণ্ড ভাগই ছিল স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম অধ্যায়। "জন্ম থেকেই স্বাধীনতা নামের শিশুটি বিকলাঙ্গ/ তবু তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে অনেক যত্নে/তার গায়ে বারবার বদলে বদলে যে-জামাটি পরানো হয়েছে/তার নাম গণতন্ত্র" (স্বাধীনতা: স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন স্বপ্ন-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)। 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে ব্রিটিশ তাড়িয়ে একক ভারত প্রথমে দু টুকরো, পরে তিন। তার আরও পরে ভারতের খণ্ডন সংখ্যায় পরিণত হল।  


"পাঞ্জাব ও বাংলা, সেখানকার ছেলেরা জীবন পণ করে/সবচেয়ে বেশি লড়াই করেছে দেশের মুক্তির জন্য/সেই দুটো রাজ্যই কেটে ফেলে বইয়ে দেওয়া হল রক্তগঙ্গা" (স্বাধীনতা: স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন স্বপ্ন-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)।  ভাগ-বটোয়ারাতে পাঞ্জাব কেটে কেটে পরিণত হয়েছে টুকরো টুকরো পাঞ্জাবে আর বাংলার পরিণতি, 'এপার-ওপার'। ভাবনার আর লেখার গৌরচন্দ্রিকা শেষ করে সোজাসুজি কথোপকথনে ঢুকছি। ওই সর্দারজি গাড়ি চালাচ্ছেন। স্পিড লিমিট ২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। ফাঁকা রাস্তায় ওইটাই ছিল সর্বোচ্চ গতি। সাইকেলটাও মারুতি ভ্যানের থেকে এগিয়ে চলে যাচ্ছিল। কোনও প্রতিযোগিতা নেই, সময়ও অনেক, তাই ধীরে, আরও ধীরে। তবে ভাবনা ছুটল মেঘের থেকেও দুরন্ত গতিতে। আমি সশ্রদ্ধায় পাপ্পাজি বলেই সম্বোধন করলাম।       


মাথায় পাগড়ি আর সাদা দাড়ি দেখলে বাঙালিদের যে স্বভাবজাত প্রশ্নটা আসে, সেটাই করলাম- পাপ্পাজি, পাঞ্জাব সে হো?
পাপ্পাজি- পাকিস্তান। (থামলেন। আমি কোনও কিছু বলার আগেই...) পাকিস্তান কি পেশোয়ার পাতা হ্যায়? (মনে মনে ভাবছি, পাকিস্তানের নাকি? আমার মতই রিফিউজি!) পাকিস্তান কি পেশোয়ার সে দিল্লি তক্‌ পাঞ্জাব থি। পেহেলে আংরেজ নে কাটা, ফের ইন্দিরা গান্ধী নে কাটা।


বছর ৮০'র বৃদ্ধ ভ্যান (মারুতি ভ্যান) চালকের ভ্যানে সওয়ার হয়ে এমন এক দেশভাগের যন্ত্রণার সম্মুখীন হব, তা কোনও কল্পনাতেই আসেনি। আমাকেও তো চলে আসতে হয়েছিল, মায়ের হাত ধরে। দেশ আমাকে ছেড়েছে, আমি দেশকে ছাড়িনি (যে সময়টা আমাকে নিয়ে এসেছিল মা, তখন আমি আর কইটুকু। বুঝি বলতে ইস্কুলে যেতে হবে সাদা শার্ট আর ব্লু প্যান্ট পরে, কাঁধে ব্যাগ, আর বিকেলে ক্রিকেট, সেটাও যদি বড়রা একটু খেলতে নিত। বল বয় কি সেটাও বুঝতাম না, দাদারা বল বাইরে মারত, আর সেটা কুড়িয়ে এনে দেওয়াটাই আমার প্রথম ক্রিকেট ক্লাস। এখন বুঝি আমি আসলে বল বয় ছিলাম।) ওপার হইতে এপার। পিঠে তো কাঁটাতারের দাগ দেখিনা, তাই বাচোয়া, শরণার্থীই আমি আর আমার মা, অনুপ্রবেশকারী নই। সেই ছোট্ট থেকেই ক্রিকেট দেখে সচিন-সৌরভের দেশকে কখনও বিদেশ মনে হয়নি। ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া করে চিৎকার আর সচিন-সৌরভ আউট হলেই আমার যখন মন খারাপ হত, তখন তো আমাকে বলে দেওয়া হয়নি, মন খারাপের কী আছে, সে তো আমার দেশ নয়, বিদেশ। সচিন-সৌরভের দেশে পা রাখতেই মনে হল বিদেশ। বাংলায় কথা বলি ঠিকই কিন্তু খাইসো, আইসোর বদলে আয়ত্ত করতে হয়েছে 'খেয়েছি', 'এসেছি', আরও কত 'ভদ্র' লোকেদের বক্তব্য। 'মদ খেকো পরিচালক' ঋত্ত্বিক কুমার ঘটকের মতই একটা যন্ত্রণা হয়। ঢাকাও এখন বিদেশ। শুক্রবারের সরকারি ছুটি রবিবারে ট্রান্সফার। ছুটির দিন পরিবর্তন আসলে দেশ পরিবর্তন একথা বুঝতে আর অসুবিধা হয়না। ভাষা, সংস্কৃতি, রক্তে এক হলেও বাংলা ও পশ্চিমবাংলা ভাগাভাগির ফলাফল। ফ্ল্যাশব্যাক থেকে আবার ২০ কিলোমিটার গতিতে চলা ভ্যান যানে ফিরলাম। (এত তারাতারি ভারত থেকে বাংলাদেশ আবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফেরা যায় কল্পনাতেই)


পাপ্পাজি কি পাকিস্তানে থাকতেন? এখনও জানি না। আমার কিছু বলার আগেই আবার পাপ্পাজি বলতে শুরু করলেন। "আংরেজ নে পেহেলে দো টুকরে কর দিয়ে। কোওন বনেগা দেশ কি মুখিয়া? পণ্ডিতজি ওর জিন্না সাহেব নে আপসমে ঝগড়তে রেহে। গান্ধীজি নে বহত কোশিস কিয়ে থে। নেহেরু ওর জিন্নাজি সে ও কেহেতে রেহে একদফা বন জানে দো, চুনাও আয়েগা তো চুনাও সে দেশকা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোঙগে। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু নেহি মানে, না মানে জিন্না সাহেব নে। মুসলিম লিগ বানাকে বন গেয়া পাকিস্তান, ইধরি হামারে ইন্ডিয়া। কাট গেয়া পাঞ্জাব।" থামলেন পাপ্পাজি। একটু পরেই বলতে শুরু করলেন, "ইসকে বাদ ইন্দিরা গান্ধীনে ওর টুকরে বানা দিয়ে। পাঞ্জাব কাট গেয়া ফিরসে। এক হিমাচল, দু'সরা হারিয়ানা। সেরফ চণ্ডীগড় রেহে গেয়া"।


চোখটায় যেন বরফপাত। জল পড়ল না। বুঝলাম পাপ্পাজির ইস্পাতসম হৃদপিণ্ড হঠাৎ যেন খন্ড বিখন্ড পাঞ্জাবকে জুড়তে চাইলো। চোখের লাল মেঘলা আভায় আর বৃষ্টি নয়, গর্জনও নয়। কথা বাড়ানোর আগেই কালকা এসে গিয়েছে। পাপ্পাজি বললেন, "ও রাহা আপকা মঞ্জিল। কালকা স্টেশন"। নামলাম। হাতজোড়া করে নমস্কার জানালেন পাপ্পাজি। আর কোনও কথা হল না, নমস্কার জানালাম আমিও।


পাপ্পাজি পাকিস্তানের? পাপ্পাজি পাঞ্জাবের? পাপ্পাজি হরিয়ানার? পাপ্পাজি হিমাচলের? উত্তর- ভারত ভাগের আগেও পাপ্পাজি ভারতের, স্বাধীনতার পরেও ভারতের। স্বাধীনতার ভাগাভাগিতে নদী ভাগ হয়েছে, জলের দখল হয়েছে, কিন্তু উৎস আর মোহনার দখল কাউর নয়। কেউ পারেনি। তাই পাপ্পাজিও সেই স্বাধীন নদী। যার আছে পাকিস্তানের পেশোয়ার, যার আছে পাঞ্জাব। যার আছে ভারত।


হিমাচলের বরফ বৃষ্টির গল্প লিখব ভেবে শেষে পাঞ্জাবের কেটে যাওয়ার গল্প লিখতে হল। হা... (দীর্ঘশ্বাস)।