বেলচির `দলিত` ক্ষমতায় ফিরিয়েছিল ইন্দিরাকে, হাথরস কি প্রিয়াঙ্কাকে?
অনির্বাণ সিনহা
অনির্বাণ সিনহা
রাজনৈতিক জীবনে বরাবর জনসমক্ষে, মাথায় ঘোমটা টানা ইন্দিরা গান্ধীর গোড়ালি একবারই দেখা গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বিহারের বেলচিতে। রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে টালমাটাল সময়ে,সরকার তো বটেই, দলের ভিতরেই কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হারানো ইন্দিরা কাদায় পা ডুবিয়ে, এক ঝটকায় টেনে তুলেছিলেন নিজের কর্দমাক্ত ইমেজ আর কংগ্রেসকে।
'৭৭-এর জুলাইয়ে সেদিন ইন্দিরার বেলচিযাত্রার পটভূমিতে কী ছিল? ৬ মাসও হয়নি, সারা দেশের সঙ্গে বিহারেও ইন্দিরা আর তার কংগ্রেসকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সাধারণ মানুষ।বিহারে তখন জয়প্রকাশ নারায়ণ আর রামমনোহর লোহিয়ার ভাবশিষ্য কর্পূরী ঠাকুরের জমানা। লালুপ্রসাদ যাদব আর নীতীশ কুমার তখন নেহাতই কর্পূরীর স্নেহধন্য ছাত্রনেতা।সামাজিক ন্যায়ের প্রবক্তা আর দলিতের মসিহা সেই সরকার থিতু হয়ে বসার আগেই ঘটে গেল বিহারের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর দলিত গণহত্য়ার ঘটনা। বেলচি গ্রামে রাজপুত-ঠাকুরদের যৌথবাহিনীর হাতে নির্বিচারে খুন করা হয় ৮ জন হরিজন ও ৩ জন সোনকারকে (স্বর্ণকার)। পয়েন্ট ব্ল্য়াঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি ও তারপর জ্বলন্ত আগুনে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার খবর দেশের সংবাদপত্রগুলিতে জানা যায় ঘটনার দু'দিন পর। গ্রামের একমাত্র চৌকিদার নিকটবর্তী পুলিস ফাঁড়িতে খবর দিয়েছিলেন ১৭ কিলোমিটার পথ হেঁটে।
এহেন বেলচিতে ইন্দিরা যাওয়া দূর অস্ত, এ নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন, তা বোঝা জনতা পার্টির তত্কালীন নেতাদের কাছে তো বটেই, কংগ্রেসের নেতাদের কাছেও চিন্তার অতীত ছিল। জরুরি অবস্থার যাবতীয় কলঙ্কভার তখন ইন্দিরার মাথায়। জনতা সরকার প্রতিদিন একটি করে তদন্ত কমিটি তৈরি করছে ইন্দিরা ও সঞ্জয় গান্ধীকে কোনও না কোনও দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে। কংগ্রেসের ভিতরে ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি,সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়দের চোখে ইন্দিরা তখন 'দলের বোঝা'। তাঁরা তখন নিশ্চিত, ইন্দিরা আগে ঘর সামলাবেন, তবে না বাইরে বেরোবেন!
সেই ইন্দিরাই সবার আগে বেলচি পৌঁছলেন। প্রথমে জিপ, তারপর ট্রাক্টর,তারপর হাতির পিঠে, শেষে হাঁটু ডোবা কাদায় মাখামাখি হয়ে হেঁটে। সেদিন ইন্দিরাকে দেখে বেলচির হরিজনরা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি।
বেলচিতে খবর পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর পুলিস পৌঁছেছিল, রাস্তায় ব্রেক ডাউন ও টায়ার পাংচার সামলে। ইন্দিরা খবর পাওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে কেবল নিজের কাঁধটা এগিয়ে দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকা,সর্বস্ব হারানো হরিজন মহিলাদের বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ার জন্য যে অবলম্বনটা দরকার ছিল। সেদিন সংবাদমাধ্যমের শত অনুরোধেও, ইন্দিরা বেলচিতে দাঁড়িয়ে একটি কথাও বলেননি। বলেছিলেন, 'আজ আমি এঁদের যন্ত্রণার কথা শুনতে এসেছি। বিবৃতি দিতে নয়।' পরে পটনায় জনসভা করে কর্পূরী সরকারকে তুলোধোনা করে বলেছিলেন, 'বেঁচে থাকলে তো চাকরি! হরিজনদের সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের আগে নিরাপত্তা দিক সরকার। আর চাই বিচার।'
২০২০। পুলিসের যাবতীয় বাধা, কৌশলে আটকানোর চেষ্টাকে ততোধিক দৃঢ়তা ও কৌশলে পাশ কাটিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে দাদা রাহুল-সহ ৪ কংগ্রেস সাংসদকে নিয়ে হাথরস পৌঁছলেন প্রিয়াঙ্কা। ধর্ষিত,নিহত এক দলিত কন্যার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে।তাঁদের আসার ঘণ্টা ছয়েক আগে যে পরিবারের হাতে মেয়ের চিতাভস্ম তুলে দিয়েছে পুলিস।স্যানিটাইজার ঢেলে,গ্রামের বাজরা ক্ষেতে দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার দু'দিন পর। ইন্দিরার মতো মুখ খোলেননি ইন্দিরার নাতনিও। কেবল নিজের কাঁধটুকুই দিয়েছেন।আর সন্তানহারা হরিজন মায়ের দুঃখে নিজেও কেঁদেছেন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সংবাদমাধ্যমের সামনে কেবল দুটি কথাই বলেছেন প্রিয়ঙ্কা। উত্তরপ্রদেশের মেয়েদের নিরাপত্তা চাই।যোগী সরকারের কাছে ইনসাফ চাই। হুবহু ইন্দিরার পুনরাবৃত্তি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। হাথরস ,বেলচির মতো কংগ্রেসকে তার হারানো জমি ফেরাতে পারবে কি না, তা সময়ই বলবে।কাকতালীয় ভাবেই কি না কে জানে,কংগ্রেসের ভিতরে আজ ফের গান্ধীদের নেতৃত্ব নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠছে। জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগে স্বামী ও শ্বশুরবাড়িকে জড়িয়ে প্রিয়ঙ্কাকে ঘরে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছে মোদী সরকারও। জাতীয় রাজনীতিতেও কংগ্রেসের এখন হাতির কাদায় পড়ার দশা। ঠাকুরমার মতো কাদায় নেমে না হোক, কংগ্রেসের দিশাহীন গাড়িকে ড্রাইভ করে প্রিয়ঙ্কা কোথাও পৌঁছে দিতে পারেন কি না; সেদিকে চোখ রাখতে শুরু করল দেশ। সৌজন্যে, সেই হরিজন রাজনীতি।
আরও পড়ুন- সংখ্যালঘু ইন্দিরার ‘ব্যাকবোন’! ৩ সাংসদ নিয়েও ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ প্রণব