চিরনিদ্রায় কালাইনার: সমর্থকদের আর্তি, `ওঠো, চলো, গোপালাপুরম চলো...`
বিতর্ক সারা জীবন ঘিরে ছিল করুনানিধিকে। দাপুটে নেতার ইমেজের পাশাপাশি নিজেকে সবসময়ে একটা প্রচারের মধ্যে রাখতেন। সবমিলিয়েই নিজের এক লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তৈরি করেছিলেন কালাইনার
নিজস্ব প্রতিবেদন:
তামিল রাজনীতির একটা অধ্যায় শেষ। জীবনাবসান হল ডিএমকে প্রধান মুথুভেল করুণানিধির। সংবাদমাধ্যমে তাঁর পরিচয় শুধু করুণানিধি হিসেবে। আর ভক্তদের কাছে তিনি কালাইনার। মঙ্গলবার চেন্নাইয়ের কাবেরী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই প্রবীণ রাজনীতিক।
হুইল চেয়ার আর কালো চশমা, হাল আমলে এভাবেই জনসমক্ষে আসতেন 'কালাইনার'। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজে কখনও দিল্লিমুখী হওয়ার চেষ্টা না করলেও বহুক্ষেত্রেই অদৃশ্য সুতোয় পরিচালনা করেছেন রাজধানীর রাজনীতি। বিবিধ প্রয়োজনে দিল্লির নেতাদের বারংবার তাঁর কাছে ছুটে আসতে দেখা গিয়েছে। জয়ললিতার মৃত্যুর পর দ্রাবিড় রাজনীতির আরও এক বর্ণময় অধ্যায়ের অবসান ঘটল করুণানিধির মৃত্যুতে। হাসপাতালের বাইরে জড়ো হওয়া ভক্তদের শ্লোগান, "ওঠো...জাগো, গোপালাপুরম চলো"। উল্লেখ্য, গোপালাপুরমেই থাকতেন করুণা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমজিআর, জয়ললিতার সঙ্গে তাঁকে যেমন লড়াই করতে হয়েছে, ঠিক তেমনই লড়তে হয়েছে পারিবারিক সমস্যার সঙ্গেও। ছেলেমেয়ে থেকে নাতি, সবার রাজনৈতিক কেরিয়ার ঘোরাফেরা করেছে তাঁরই ছায়ায়। এদের জন্য চাপও সামলেছেন প্রচুর। টুজি কেলেঙ্কারিতে মেয়ে কানিমোঝির হাজতবাস, মন্ত্রী এ রাজার জড়িয়ে পড়া সবই তিনি সামলেছেন দাক্ষিণাত্যে বসেই।
আরও পড়ুন-দাসপুরে সোনা লুঠ মামলায় গ্রেফতার ভারতী ঘোষের স্বামী
অবিসংবাদী তামিল এই নেতার বিরুদ্ধে বারেবারেই দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণকে বন্ধু বলে নিজেকে একদা বিতর্কেও জড়িয়েছেন করুণানিধি। দুই নাতি দয়ানিধি মারান ও কলানিধি মারানের বাড়বাড়ন্তের পেছনেও তাঁর কলকাঠি রয়েছে বলে মনে করত রাজনৈতিক মহল। একসময় তাঁদের দল থেকে বিতাড়িতও করেন করুণানিধি। আবার ছেলে আলাগিরি ও স্ট্যালিনকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার চক্রন্তের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
১৯২৪ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির নাগাপট্টিনমে জন্ম মুথুভেল করুনানিধির। খুব অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। সামাজিক আন্দোলন থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে পা রাখেন কালাইনার।
দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগমে নাম লিখিয়ে এক সময়ে হিন্দি বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়নে করুণানিধি। দ্রাবিড়ভূমে তিনি প্রথম তৈরি করেন ছাত্র সংগঠন। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেও লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন করুণানিধি।
১৯৪৯ সালে আন্নাদুরাইয়ের সঙ্গে জোট গড়ে করুণানিধি তৈরি করেন নতুন দল- ডিএমকে। ১৯৫৭ সালে প্রথমবার তিনি কুলিথালাই বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৬১ সালে তিনি দলের কোষাধক্ষ্য পদে নির্বাচত হন। ১৯৬৭ সালে দল রাজ্যে ক্ষমতায় এলে তিনি প্রধামবার মন্ত্রী হন। পূর্ত দফতরের দায়িত্ব পান নতুন মন্ত্রী।
১৯৬৯ সালে আন্নাদুরাইএর মৃত্যুর পর তামিলনাড়ুর তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সমর্থকদের প্রাণের কালাইনার। সেই থেকে ২০১১ পর্যন্ত মোট ৫ বার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন করুণানিধি। এসবের মধ্যেই ১৯৮০ সালে তামিলনাড়ুতে করুণানিধি সরকারকে ফেলে দেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮০ সালে তামিলনাড়ুর বীরানাম প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে নাম জড়ায় করুণানিধির। সারকারিয়া কমিশনের রিপোর্টে তাঁর দিকে আঙুল তোলা হয়। এর জন্য করুণানিধি সরকারকে বরখাস্ত করে ইন্দিরা গান্ধী সরকার। তবে পতনের ইতিহাস যেমন রয়েছে, উত্থানও কম নেই। ১৩ বার নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে একবারও হারেননি করুণানিধি। দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মোট ১০ বার।
রাজনীনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি করুণানিধির পরিচিতি ছিল শিল্পী হিসেবেও। তাই ভক্তদের কাছে তাঁর পরিচিতি ছিল কালাইনার বা শিল্পী হিসেবে। রাজনীতিতে পুরোপুরি আসার আগে তিনি ছিলেন তামিল ছবির চিত্রনাট্যকার। ১৯৪৭ সালে তিনি রাজকুমারী ছবির চিত্রনাট্য লিখে বিখ্যাত হয়ে যান।
বিতর্ক সারা জীবন ঘিরে ছিল করুণানিধিকে। দাপুটে নেতার ইমেজের পাশাপাশি নিজেকে সবসময়ে একটা প্রচারের মধ্যে রাখতেন। সবমিলিয়েই নিজের এক লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ তৈরি করেছিলেন কালাইনার। তাঁর জীবনে রয়েছে একের পর এক বিতর্কও।
অারও পড়ুন-অটোয় সজোরে ব্রেক, বরানগরে মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে মৃত্যু শিশুর
২০০১ সালে চেন্নাইয়ে একটি উড়ালপুল তৈরির দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজস থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় করুনানিধি ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব কে এ নাম্বিয়ারকে। তবে কোনও অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি ছাড়া পেয়ে যান।
সেতু সমুদ্রম প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন করুণানিধি। প্রশ্ন তোলেন, কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করেছিলেন রাম যে তিনি রামসেতু তৈরি করবেন!
রাজনীতি করতে গিয়ে স্বজনপোষনের অভিযোগ ছিল করুণানিধির বিরুদ্ধে। দলে ছেলে স্ট্যালিনকে তুলে আনার জন্য দলেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
আভিযোগ, বিতর্কের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে করুণার জীবন। এবার তা একেবারেই থেমে গেল। একইসঙ্গে শেষ হল দ্রাবিড় রাজনীতির এক বর্ণময় অধ্যায়।