মোদী নয়, লোকসভায় মুখ নীতীশ!
কেন এমন বার্তা দিচ্ছেন নীতীশ?
নির্ণয় ভট্টাচার্য্য
পাঁকে পড়েছে পঙ্কজ। আর সেই পরিস্থিতির 'ফয়দা' নিতে মাঠে নেমে পড়ল নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড। সোমবার ডেডিইউ-এর বৈঠকের পর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়ে দিল, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিহারে জোটের মুখ নীতীশ কুমার এবং ৪০টির মধ্যে ২৫টি আসনে লড়বে তারা।
জোটসঙ্গীর এহেন মন্তব্য শুনে আপাতত 'জোটধর্ম'ই পালন করেছেন বিহার বিজেপির সভাপতি তথা সে রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী। তিনি বলেছেন, "দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হলেও বিহারের নেতা তো নীতীশ কুমারই। বিহারে আমরা নরেন্দ্র মোদীর নামে এবং নীতীশের কাজের ফলেই ভোট পাব। এতে তো কোনও বিরোধ নেই"। তবে সুশীল মোদী যতই 'বিরোধ নেই' বলে দাবি করুন, জেডিইউ-এর এমন 'এক তরফা' ঘোষণায় জাতীয় রাজনীতিতে ভিন্ন সমীকরণের গন্ধ পাচ্ছেন পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের 'জমিদারি মানসিকতা' ঘুচে গিয়েছে বহুদিন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের মোট সাংসদ সংখ্যা ৪৮ যা যে কোনও আঞ্চলিক দলের সাংসদ সংখ্যার প্রায় সমান। পাশাপাশি, একের পর এক রাজ্যের রাশও বেরিয়ে গিয়েছে হাত থেকে। ফলে, রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসকে এখন 'বাস্তবতা এবং বাধ্যবাধকতা' দুটি বুঝেই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কংগ্রেসের এমন 'বোধদয়ে'র সাম্প্রতিক প্রতিফলন মিলেছে কর্ণাটকে জেডিএস-কে মুখ্যমন্ত্রীর আসন ছেড়ে দেওয়া ও উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে আসন সমঝোতরার মধ্য দিয়েই। কিন্তু একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকারে আসা '৫৬ ইঞ্চির' মোদী সরকারকে নিকট অতীতে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
২০১৪ সালে দেশব্যাপী মোদী ঝড় এবং তারপর একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে মোদী-শাহর অশ্বমেধের ঘোড়া বিনা বাধায় ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক কালে উত্তরপ্রদেশের একাধিক লোকসভা আসনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের সামনে লজ্জার পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে পদ্ম শিবিরকে। পাশাপাশি, বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে কর্ণাটকও ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। অন্যদিকে, এনডিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি এবং দীর্ঘদিন ধরেই অস্বস্তিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা। এমতাবস্থায় বেশ কিছুটা কোণঠাসা ভাজপা। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের সমীকরণে নয়া রঙ লাগাল নীতীশ কুমারের দল।
সম্প্রতি জোকিহাটে 'সম্মানের লড়াইয়ে' হারতে হয়েছে নীতীশকে। বরং তাঁর মতো দুঁদে রাজনীতিককে টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন রাজনীতিতে তাঁর কাছে 'দুধের শিশু' তেদস্বী যাদব। 'যাদব কুলপতি' লালু জেলে থাকলেও, জোকিহাটে লণ্ঠন জ্বেলে 'লালুবাদের জয়' ঘোষণা করেছেন তেজস্বী। তবে, নীতীশের দল হারের পরই এর সব দায় চাপিয়েছে পেট্রল-ডিজেলের দামের উপর। অর্থাত্ তাঁদের মতে, এই হারের কারণ নীতীশের প্রতি অনাস্থা নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেই বিমুদ্রাকরণ নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন নীতীশ। আর মোদী সরকারের ৪ বছর পূর্তিতে তো প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইটারেই তাঁকে অস্বস্তিতে ফেল দিয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি লিখেছিলেন, মোদী সরকারের উচিত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা। অর্থাত্ মোদী সরকার যে প্রতিশ্রুতি পূরণ করে উঠতে এখন সফল নয়, ইঙ্গিত ছিল সেদিকেই।
কেন এমন বার্তা দিচ্ছেন নীতীশ?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, এ মুহূর্তে এমন অবস্থান নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথও খোলা নেই নীতীশ কুমারের সামনে। লালু ও কংগ্রেসের হাত ধরে মহাজোট তৈরি করে বিহারে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে বেশ ভাল অবস্থাতেই ছিলেন মোদীর জন্য এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসা নীতীশ কুমার। কিন্তু, দুর্নীতিগ্রস্থ লালুর ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে এবং কেন্দ্রীয় চাপের মুখে পড়ে মহাজোট সরকার থেকে বেরিয়ে ফের এনডিএতে-ই ফিরে আসতে বাধ্য হন নীতীশ। আর ফিরে আসাই তাঁর কাল হয়েছে। কারণ, বিরোধী শিবিরে থাকলে মোদী সরকারের বিরোধীয় তিনি যতটা চোখে পড়তেন, এখন আর সেই অবকাশ নেই। বরং, একের পর এক উপনির্বাচনে জেলবন্দি লালুর দলের কাছে হেরে এনডিএতেও তিনি বেশি গলা তুলতে পারছিলেন না। আর সেখান থেকেই পরাজয়ের দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, সম্প্রতি একের পর এক উপনির্বাচনে বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরায় বাড়তি অক্সিজেন পেয়েছেন নীতীশ কুমার। আর সেখান থেকেই পাল্টা চাপ দিতে শুরু করেছেন তিনি।
তবে, নীতীশ যে পরিস্থিতিতেই এমন কৌশল গ্রহন করুক তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু, আসল কথা হল, একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় বলীয়ান বিজেপিকেও যে লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে জোটসঙ্গীদের 'উঁচু গলা' সহ্য করতে হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে অভিনব। ফলে, অবস্থার বিচারে দেশের দুই বড় দল কংগ্রেস ও বিজেপি এখন কার্যত একই সারিতে বসতে চলেছে। তবে, অবশ্যই বিজেপির অবস্থা এক্ষেত্রে কংগ্রেসের থেকে বেশ খানিকটা ভালো, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, দীর্ঘকাল পরে বিগত চার বছর দেশ যেমন একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের শাসন দেখল, আগামী দিনে তেমনটা হওয়ার আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। ফলে, জোট রাজনীতি এবং তাতে আঞ্চলিক দলগুলির তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।তাই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা বড় ভাইয়ের ঔদ্ধত্য নয়, বহুত্ববাদের ভারতবর্ষে বহুস্বরই (আঞ্চলিক দল) ফের হতে চলেছে দেওয়ালের লিখন।