নালন্দা থেকে হাভার্ড হার্ডওয়ার্ক, তারই জেরে কি `প্রতীচী` বিতর্ক?
অমর্ত্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বারবার জানানো সত্ত্বেও এ বিষয়ে কর্ণপাত করেননি তিনি।
নিজস্ব প্রতিবেদন: মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার সরব হয়েছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তারই মাসুল কি গুনতে হচ্ছে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদকে?
শান্তিনিকেতনে তাঁর বাড়ি নিয়ে বিতর্কের পরেই তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছেন মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। চিঠির বয়ানে তিনি বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধাচরণের কারণেই অযথা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বর্ষীয়ান এই অর্থনীতিবিদকে।
বিতর্ক মাথা চাড়া দেওয়ায় 'প্রতীচী' নিয়ে মুখ খোলেন অমর্ত্য সেন নিজেও।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ঠিক কোন জায়গায় বিতর্ক এই বাড়িটি ঘিরে? বিতর্ক তৈরির আদৌ কোনও জায়গা আছে, নাকি পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কখনওই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাঁকে কিছু অভিযোগ করেনি। নব্বই বছরের লিজ নেওয়া এই জমিতে কয়েক পুরুষের বাস সেন পরিবারের। কখনও কোনও বেনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে হকার উচ্ছেদ ইস্যুতে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে বিতর্কে জড়ায় অমর্ত্য সেনের নাম। নোবেলজয়ীর অভিযোগ, বারবার মোদী সরকারের নীতির সমালোচনা করায় ইচ্ছাকৃত ভাবে এই জমি বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছেন মাত্র।
যদিও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, শুধু 'প্রতীচী' নয়, বিশ্বভারতীর সীমানা-লাগোয়া বেশ কিছু প্লটেই দীর্ঘদিন ধরে এই গন্ডগোল হয়ে আছে। বিশ্বভারতীর নিজস্ব জমির কিছু অংশ ঢুকে রয়েছে 'প্রতীচী'র সীমানার মধ্যে। ১২৫ ডেসিমেল জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। আশি বছর আগে তৈরি হয় 'প্রতীচী'। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর তরফ থেকে জানানো হয়, 'প্রতীচী'র সীমানার মধ্যে বিশ্বভারতীর নিজস্ব ১৩ ডেসিমেল জমি ঢুকে যাওয়ায় এখন 'প্রতীচী'র মোট জমির পরিমাণ ১৩৮ ডেসিমেল। তাই জমির পরিমাপ নতুন করে করার জন্যই রাজ্য সরকারকে চিঠি পাঠানো হয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে, জানানো হয় অমর্ত্য সেনকেও। এর পাশাপাশি বিশ্বভারতী এ-ও জানায়, আগের উপাচার্য রজতকান্ত রায়ের সময়েও এই বিষটি জানানো হয় প্রবীণ অর্থনীতিবিদকে, কিন্তু তিনি তখনও এতে কর্ণপাত করেননি।
প্রসঙ্গত, মোদী সরকারের সমালোচনায় শুরু থেকেই সরব থেকেছেন অমর্ত্য সেন। ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে সিএএ, এনআরসি ইস্যুতেও কড়া ভাষায় মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন অমর্ত্য। দেশের গণতন্ত্রের ছবিটা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে বলেও একাধিকবার মন্তব্য় করেছেন তিনি। এমনকী আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মেও মোদী সরকারকে সাম্প্রদায়িক বলে দেগেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন বহুত্ববাদের দেশে মোদী সরকারের আমলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ বেড়েছে। মাত্রা ছাড়িয়েছে অসহিষ্ণুতা।
মোদী সরকারে অর্থ-নীতি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্রমশ পিছনে দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নোটবন্দি একটি যুগান্তকারী ভুল সিদ্ধান্ত বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন, 'নোটবন্দি ভুল সিদ্ধান্ত নয়, কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।' যদিও এই মন্তব্যের পাল্টা দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে। উত্তরপ্রদেশের এক সভা থেকে তিনি নোবেলজয়ীকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, 'হাভার্ডের থেকে হার্ডওয়ার্কের শক্তি অনেক বেশি।'
প্রথম দফায় মোদী সরকার আসার পরের বছর ২০১৫ সালেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে ইস্তফা দেন অমর্ত্য সেন। তাঁর মেয়াদ বাড়ানোও হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপই এর মূল কারণ বলে জানা গেলেও পরবর্তীতে বিতর্ক বাড়ে একাধিক বিজেপির নেতার টুইট ঘিরে। যেখানে সরাসরি আক্রমণ করা হয় নোবেলজয়ীকে। যার সাম্প্রতিকতম সংযোজন সুব্রহ্মনিয়ম স্বামী। যিনি বলেন 'নালন্দাকে শুধু লুঠ করা ছাড়া আর কিছুই করেননি অমর্ত্য সেন।'
দ্বিতীয় দফায় মোদী সরকার আসার পরেও ভূমিকা বদলাননি অমর্ত্য সেন। ২০১৯ সালে ভোটের ফলাফলের প্রেক্ষিতে তিনি বলছিলেন, নরেন্দ্র মোদী ভোটে জিতেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মতাদর্শ জেতেনি। এমনকী পুলওয়ামার প্রেক্ষিতেও কটাক্ষ করেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ। গতবছর জেনএনইউ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পুলিসের ভূমিকা প্রসঙ্গেও মোদী সরকারকে একহাত নেন অমর্ত্য। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনেও আগাগোড়া পাওয়া গিয়েছিল তাঁকে।
বিগত বছরগুলিতে একাধিক ঘটনার নিরিখেই তাই রাজনীতি এবং বুদ্ধিজীবীমহলের একাংশের বক্তব্য, শুধুমাত্র দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর সমালোচনার কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই 'প্রতীচী' নিয়ে এই নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে।
Also Read: ভিত্তিহীন অভিযোগ বিশ্বভারতীর বহিরাগতদের, বাড়ি বিতর্কে অমর্ত্যকে চিঠি Mamata-র