রেজিগনেশন রাজনীতি
ওয়েব ডেস্ক: রাজ্যসভা, ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ। দেশের অঙ্গরাজ্যগুলির বিধায়কদের ভোটে জিতে এই কক্ষের সদস্যপদ পেতে হয়। আর নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন সাধারণ নির্বাচনের দ্বারা সরাসরি জনগণের ভোটে। সদস্যপদ লাভের বিষয়টি তো সকলেরই জানা, কিন্তু সাংসদদের ইস্তফা দেওয়ার নিয়মটা ঠিক কী? সম্প্রতি বহুজন সমাজ পার্টির সুপ্রিমো মায়াবতী রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করায় আবারও সামনে এসেছে সংসদের উচ্চকক্ষ থেকে ইস্তফা দেওয়ার নিয়মের জটিলতা। এর আগেও বহুবার লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে সাংসদদের পদত্যাগের পদ্ধতি নিয়ে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। ফলে আইনসভা থেকে ইস্তফার প্রকৃত নিয়মটি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
পদত্যাগের নিয়ম-
রাজ্যসভা থেকে যদি কোনও সাংসদ ইস্তফা দিতে চান তাহলে উপরাষ্ট্রপতি তথা পদাধিকার বলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের উদ্দেশে সেই সাংসদকে নিজে হাতে লেখা ইস্তফাপত্র জমা দিতে হবে।
যদি কোনও সাংসদের ইস্তফাপত্র ডাক বা অন্য কোনও ব্যক্তি মারফত জমা পড়ে, সেক্ষেত্রে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান নিজে বা সচিবালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখতে
পারেন এই ইস্তফা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দেওয়া হচ্ছে কিনা।
ইস্তফাপত্রটি হতে হবে অতি সংক্ষিপ্ত (পড়ুন, এক লাইনের) এবং নিঃশর্ত।
ইস্তফাপত্রে পদ ছাড়ার কোনও কারণ লিখতে পারবেন না পদত্যাগী সাংসদ, শুধুমাত্র তিনি যে স্বেচ্ছায় এই পদ ত্যাগ করছেন লিখতে হবে সেকথা।
কিন্তু সাংসদদের পদত্যাগ নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে কেন এই 'হয়রানি'?
দলিত শ্রেণীর কথা তুলে ধরতে দেওয়া হয়নি এই অভিযোগে ক্রুদ্ধ রাজ্যসভার সাংসদ মায়াবতী পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়ে দেন। তাঁকে যদি পিছিয়ে পড়া এই শ্রেণীর কথাই তুলে ধরতে না দেওয়া হয় তাহলে তিনি সভার সদস্য থেকে কী করবেন, এই কথা বলে তাঁর যাবতীয় আপত্তি ও ক্ষোভের কারণ জানিয়ে তিন পাতার ইস্তফাপত্র জমা দেন তিনি। কিন্তু নিয়ম যেহেতু ইস্তফাপত্র 'অতি সংক্ষিপ্ত' (পড়ুন, এক লাইন) এবং 'পদত্যাগের কারণবিহীন' হতে হবে তাই তাঁর ইস্তফাপত্র গৃহীত হয়নি। ফলে রীতি মেনে পদত্যাগপত্র জমা পড়ায় আজ গৃহীত হয়েছে তাঁর পদত্যাগ।
প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা পঞ্জাবের কংগ্রেস সরকারের বর্তমান মন্ত্রী নভজ্যোত সিং সিধু যখন গত বছর লোকসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তখন তাঁর প্রথম ইস্তফাপত্র গৃহীত হয়নি। কারণ, সিধু লিখেছিলেন, তিনি "নীতিগত কারণে পদত্যাগ করছেন"। পরের দিন সিধুকে নতুন করে ইস্তফাপত্র জমা দিতে হয় যেখানে উল্লেখ ছিল না কোনও কারণ এবং সেই পত্র গ্রহণ করে লোকসভা।
সিধু বর্তমানে যে সরকারের অঙ্গ, সেই পঞ্জাব সরকারেরই মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-এরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল যথন তিনি শতদ্রু-যমুনা সংযুক্তি চুক্তিকে কেন্দ্র করে লোকসভা থেকে পদত্যাগ করতে চান। অমরিন্দর সিং সেসময় প্রথমে তাঁর নীতিগত অবস্থান ব্যাখ্যা করে সুদীর্ঘ ইস্তফাপত্র জমা দেন। কিন্তু বাতিল হয়ে যায় সেই চিঠি। অবশেষে তাঁকে পুনরায় সংক্ষিপ্ত ও কারণবিহীন ইস্তপাপত্র জমা করতে হয়।
কিন্তু এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, মায়াবতী, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-এর মতো সংসদীয় রাজনীতির পোড় খাওয়া কুশীলবরা কি সত্যিই সভার নিয়মকানুন সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ? আর এখানেই চলে আসছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রসঙ্গ। কারণ, অতীত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এইসব সাংসদরা সুনির্দিষ্ট কোনও ইস্যুকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির আশাতেই নিজেদের 'শহিদ' করেন। ফলে প্রাথমিকভাবে তাঁরা সকলেই নিজের 'নীতিগত অবস্থান' বা 'ক্ষোভের কারণ' ব্যাখ্যা করতে চান তাঁদের ভোটব্যাঙ্কের কাছে নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে। আর সেজন্যই প্রথমে বড় আকারের চিঠি জমা পড়ে সংসদের দু'কক্ষেই। আর তারপর 'বার্তা পৌঁছে গেলে' মানে মানে জমা করে দেন নিয়ম মাফিক ইস্তফাপত্র। এই হল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পীঠস্থানে প্রবেশ ও প্রস্থানের বাস্তব ছবি যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নির্ভেজাল রাজনীতি।