SC On Same-Sex Marriage: মহাভারতের মহাবীর অর্জুন পুরুষ, না কি নারী? তিনিই আদি `ট্রান্সজেন্ডার`?
Supreme Court Verdict On Same-Sex Marriage: `জেন্ডার ভ্যারিয়েন্স` বা লিঙ্গপরিচয়ের বৈচিত্র্যের দিক থেকেও অর্জুন খুব মনে রাখার মতো চরিত্র। যেদিন দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গের প্রেম-বিবাহ বা তাঁদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটাল, সেদিন তাই অর্জুনকে মনে না পড়াটা খুব আশ্চর্যের!
সৌমিত্র সেন: মহাভারতের অর্জুন চরিত্রটি নানা দিক থেকেই খুব চিত্তাকর্ষক। 'জেন্ডার ভ্যারিয়েন্স' বা লিঙ্গপরিচয়ের বৈচিত্র্যের দিক থেকেও অর্জুন খুব মনে রাখার মতো চরিত্র। যেদিন দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমলিঙ্গের প্রেম-বিবাহ বা তাঁদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটাল, সেদিন তাই অর্জুনকে মনে না পড়াটা খুব আশ্চর্যের!
অনন্য সুন্দরী অপ্সরা উর্বশীর প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় অর্জুনকে শাপ দিলেন তিনি। কী শাপ? অর্জুন এক বছর 'ক্লীব' হয়ে বাঁচবেন! 'ক্লীব' বলতে? 'ক্লীব' বলতে মহাভারতকার অনেকখানি এগিয়ে বুঝিয়েছিলেন একটা তৃতীয়া প্রকৃতি (থার্ড জেন্ডার), যিনি নারীও নন, পুরুষও নন, এর মাঝামাঝি তৃতীয় কিছু অন্য কিছু, অপর কিছু। সে যাই হোক, মোট কথা, উর্বশীর শাপে ভয়ংকর চিন্তায় পড়ে গেলেন কুন্তীপুত্র মহাবীর অর্জুন। তখন সখা কৃষ্ণ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, উর্বশীর এই শাপ তাঁর পক্ষে একদিন বর হবে!
বনবাসের পরে এক বছরের অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়েই অর্জুন কৃষ্ণের কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করলেন। উর্বশীর অভিশাপে ক্লীব হওয়ায় নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না তাঁকে। দ্রৌপদী-সহ পঞ্চপাণ্ডব নামপরিচয় গোপন রেখে ভিন্ন নামে মৎস্যরাজ বিরাটের দ্বারস্থ হলেন। অর্জুন বৃহন্নলা নাম গ্রহণ করলেন। তিনি তখন আর পুরুষ নন, নারী-পুরুষের মধ্যবর্তী এক সত্তা, অর্ধনারী। তবে, রাজা এতকিছু জানতেন না, তিনি ভেবেছিলেন অর্জুন নারীই। ফলে এমন এক ব্যক্তির কাছে উদ্ভিন্নযৌবনা রাজকুমারী উত্তরার নৃত্যগীতের শিক্ষার ভার দিতে খুব দ্বিধা করলেন না তিনি।
তবে একটা খটকা তাঁর লেগেছিল। অর্জুনের সুদৃঢ় লোমশ হাত সেই খটকার জন্ম দিয়েছিল। এমনিতেও বিরাটরাজা ভাবতে পারেননি, শরীরে যিনি পুরুষের মতো সবল-সুগঠিত মনে বা চরিত্রে বা প্রকৃতিতে তিনি একজন নারী হতে পারেন! অর্জুনের হাত দেখে তিনি আন্দাজ করলেন, এই ব্যক্তি এক মহাবীর, অসাধারণ কোনও ধনুর্ধর! অর্জুনকে সে কথা জিজ্ঞাসাও করেন তিনি। উত্তরে অর্জুন বললেন, একমাত্র যে তন্ত্রটি তিনি বাজাতে পারেন, সেটি বীণার তার। সেইমতো তাঁকে বীণা বাজিয়ে শোনাতেও হল বিরাটরাজাকে। সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনের হাতে বিরাটরাজা তাঁর কন্যার নৃত্যসংগীতশিক্ষার ভার দিলেন। এবং কন্যা উত্তরাকে বিরাটরাজ বৃহন্নলানাম্নী অর্জুনকে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে অন্তঃপুরে রাখার নির্দেশ দেন। শোনা যায়, অন্তঃপুরে এসেও শিল্পীপটীয়সী নারীদের সামনে আবারও পরীক্ষা দিতে হয়েছিল অর্জুনকে। দিতে হয়েছিল এমনকি যৌনতার পরীক্ষাও! এদিকে, বৃহন্নলা অর্জুন তো তখন সত্যিই আর পুরুষ নন, উর্বশীর অভিশাপে ক্লীব তিনি! কী আশ্চর্য সমাপতন! কী অদ্ভুত রূপক!
যদিও বিরাটরাজ বৃহন্নলাকে প্রকৃতি বা নারী-রূপেই দেখেছিলেন। এবং এমন অদ্ভুত নারীকে তিনি উপহাস করেননি, তাঁকে নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গও করেননি। উল্টে, তিনি ওই অপর যৌনপরিচয়ে পরিচিত বৃহন্নলাকে সম্মান দিয়েছিলেন। ভারতীয় মানসের এ-এক আশ্চর্য উদারতা বইকি! তথাকথিত 'আদার'বা 'অপর'কে দূরে না রেখে তাকে মূলস্রোতের দিকে টেনে নেওয়ার মনোভাব।
অর্জুনের জীবনের আর একটি ঘটনাও আছে। এটি মেলে 'পদ্মপুরাণে'। সেখানে পাওয়া যায়, কৃষ্ণের সখীদের সঙ্গে নৃত্যের উদ্দেশ্যে অর্জুনকে আক্ষরিক অর্থেই পুরুষ থেকে নারী হতে হয়েছিল, ধারণ করতে হয়েছিল নারীদেহই। কেননা, ওই নৃত্যে অংশ নিতে পারতেন একমাত্র নারীই!
আরও পড়ুন: সমপ্রেমের ইতিহাস অতি প্রাচীন, বিশ্ব জুড়ে তার নজির...
ভাবা যায়! এমন ভীষণ প্রবল এক পুরুষ, এমন মহাপরাক্রমশালী বীর, জগৎ-বিখ্যাত ধনুর্ধর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনও পুরুষ, কখনও নারী, কখনও নারী-পুরুষের মধ্যবর্তী সত্তা! আশ্চর্যের এবং প্রশংসারও যে, আজ থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে মহাভারত বিষয়টি যিনিই ভাবুন বা লিখুন, তিনি মননে-সৃজনে কতটা আধুনিক ছিলেন, কতটা বিচিত্রগামী ছিলেন, কতটা উদার ও সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন! অর্জুন সেই ভাবুক-রাজার প্রটাগনিস্ট বই তো নন!