সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

শ্রীঅরবিন্দ ভারতীয় সংস্কৃতির এক উজ্জ্বলতম নাম সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-ও সত্য যে, ইদানীংকালের ভারত তেমন করে অরবিন্দচর্চা করে না, যেমনটা করলে ঘরে-ঘরে অরবিন্দের নাম উচ্চারিত হয়। নব্য প্রজন্ম তাঁকে চেনে খুব কম। ফলে সেই হিসেবে তাঁকে 'প্রায় অনালোচিত বা স্বল্পালোচিত ব্যক্তিত্বে'র বর্গে হয়তো ফেলাই চলে।


অথচ, মোটেই এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। অরবিন্দের মতো এমন প্রবলতম এক নবজাগরণ-ব্যক্তিত্বের ভারতীয় সংস্কৃতিতে (বিশ্ব এখানে আপাতত নয় উহ্যই থাক) যে মাপের অবদান, তাতে প্রায় সমস্ত ভারতবাসীরই বাধ্যতামূলক ভাবে অরবিন্দ-চর্চায় অন্তত কিছুটা হলেও নিমগ্ন হওয়া উচিত। কিন্তু অরবিন্দ চিরকালই 'মাস' থেকে যেন একটু দূরে, আর 'মাস'ও যেন উল্টো দিকে তাঁর থেকে একটু দূরেই।


আরও পড়ুন: Sarojini Naidu: দেশের কাজের বিপুল চাপেও তাঁর হাতে ধরা থাকত কবিতার জাদুবাঁশি


এর একটা বড় কারণ, অরবিন্দের সার্বিক দুর্বোধ্যতা। প্রথম থেকেই ভয়ঙ্কর একটা মেধা তাঁকে মননের এমন চূড়ান্তে স্থাপন করে রেখে এসেছে যে, সাধারণ তাঁর কাছে ঘেঁষতে গিয়ে যেন হীনম্মন্যতা ভুগেছে। এর উপর যোগ হয়েছে তাঁর জটিল-যৌগিক জীবন; জীবনের একবারে প্রথম লগ্নে ইংরেজের আমলা হওয়ার অধ্যবসায়, পরে বরোদার রাজার সহায়ক, এরও পরে স্বাধীনতাসংগ্রামে যোগ, সেখানে একেবারে চরমপন্থা অবলম্বন, এ থেকে বোমা মামলায় জড়িয়ে পড়ে কারাবাস এবং সেখান থেকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে এক দীর্ঘ নিভৃতবাসের পথ ধরে সুগভীর আধ্যাত্মিকযাপনে উত্তরণ! পর্বে-পর্বে গাঁথা নানা-অরবিন্দের এই মালা বাঙালি তথা ভারতীয়ের হিসেবকষা খোপে-আঁটা একরৈখিক জীবনযাত্রার সমূহ বিপরীতে এমন এক গন্ধসঘন প্রগাঢ় জটিল অতুল উদ্ভাস যে, তাকে যেন ধারণ করা যায় না। শ্রদ্ধায় সরিয়ে রাখতে হয়। অরবিন্দের কপালে তাই শ্রদ্ধা জুটলেও চর্চা জোটেনি সেই অর্থে। 


'স্বাধীনতা ৭৫' আজ অন্তত সেই বন্ধ মুখ দিক খুলে।  অরবিন্দ একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বলেই শুধু নয়, আজ তো তাঁর জন্মদিনও! 


১৮৭২ সালের আজকের দিনেই কলকাতায় জন্ম তাঁর। মা স্বর্ণলতাদেবী রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জন। তিনি সন্তানদের ভারতীয় প্রভাবমুক্ত এক সম্পূর্ণ ইংরেজি ধরনে শিক্ষাদানের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই মতো ১৮৭৭ সালে দুই অগ্রজ মনমোহন এবং বিনয়ভূষণ-সহ অরবিন্দকে দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্টে পাঠান। পরে ইংল্যান্ড। সেখানে পড়াশোনায় নানা কৃতিত্বের পরিচয়। কিন্তু কৈশোর-উত্তীর্ণ অরবিন্দের মনে তখন আর ইংরেজের গোলামি করার সাধ বা স্বপ্ন নেই। অচিরেই তিনি বিলেত ছেড়ে ভারত-অভিমুখে যাত্রা করলেন। ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি। ভারতে এসে বারোদায় স্টেস সার্ভিসে যোগ দিলেন।


এই বারোদাতেই একটু-একটু করে পাল্টে যেতে থাকা শুরু অরবিন্দের। এখানেই তিনি ভারত-সংস্কৃতির উপর গভীর অধ্যয়ন শুরু করেন। শেখেন সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা। বরোদাতেই তাঁর সাহিত্য-প্রতিভারও উন্মেষ। বারোদা থেকেই তাঁর প্রথম কাব্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। ঠিক এই সময়েই তিনি ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয় রাজনীতিতেও আগ্রহী হন। বারোদাতেই পর্দার আড়াল থেকে এ সংক্রান্ত কাজও শুরু করে দেন। বিপ্লবীদলগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। এই পর্বেই তিলক, নিবেদিতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। অর্থাত্‍, ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে ওঠে। ১৯০৩ সালেই একটি বই লিখে বিপ্লবী দলের সদস্যদের মধ্যে গোপনে প্রচার করেন অরবিন্দ। 


১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বরোদার চাকরি ছেড়ে তিনি বাংলায় আসেন। জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কলেজের (বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম অধ্যক্ষ ও বিপিনচন্দ্র পালের ইংরেজি সংবাদপত্রে 'বন্দেমাতরম্'-এর সম্পাদক হন। এ পত্রিকায় জনৈক পাঠকের রাজদ্রোহী বক্তব্য প্রকাশিত হলে ১৯০৭ সালে অরবিন্দ ও বিপিনচন্দ্র উভয়েই অভিযুক্ত হন। বিপিনচন্দ্রের ছ'মাস জেল হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অরবিন্দ মুক্তি পান। টানা পাঁচ বছর (১৯০৬-১৯১০) সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থেকে অরবিন্দ অবশেষে বিপ্লবী দলের নেপথ্য নায়ক হিসেবে পরিচিত হন। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা মারা হলে সেই মামলায়  নাম জড়ায় অরবিন্দেরও। ৩ মে অরবিন্দকে গ্রেফতার করা হয়। ৯ মে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র, বোমা ও অন্যান্য কাগজপত্র-সহ অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করে। শুরু হয় আলিপুর বোমা মামলা। মামলার রায়ে কারও কারও শাস্তি হয়। অরবিন্দ শেষপর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান। দিনটি ১৯০৯ সালের ৬ মে। 


কিন্তু মুক্তি-পূর্বে কারাবাস-পর্বেই অরবিন্দের অন্তর্পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়ে গিয়েছিল। জেলে থাকা অবস্থাতেই অরবিন্দ আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কারামুক্তির পরে তাই আর নিজের আগুনে কর্মকাণ্ডের দিকে ফিরে যাননি। বরং নিজের ভেতরের যজ্ঞাগ্নির দিকে চোখ রাখলেন। বুঝলেন তাঁকে পথ বদলাতে হবে। কারামুক্তির পর এবার অন্তর্মুক্তি! ১৯১০ সালে রাজনীতির সমস্ত সংস্রব পরিত্যাগ করে পন্ডিচেরী চলে যান অরবিন্দ। ডুবে যান এক অতলান্ত প্রশান্তির নিগূঢ় গম্ভীর অধ্যাত্মসাধনায়। এভাবেই বিপ্লবী অরবিন্দ ক্রমে 'ঋষি অরবিন্দে' পরিণত হলেন। 


কিন্তু এ তো নিছক সালতামামি। এই পরিসংখ্যান-খোসার আস্তরণের নীচে শ্রীঅরবিন্দের যে বিপুল জীবনবৈভব, সাধারণ তার খোঁজ পায় না। সেই শাঁসে সংহত প্রভাতের যে অতুল সূর্যরেণু বিম্বিত হয় সেখানে সাধারণের বোধ পৌঁছয় না। মহাসাধক অরবিন্দকে বুঝতে গেলেও তাই বোধ হয় এক অন্যতর সাধনাতেই নেমে পড়তে হয়। নামছেনও অনেকে। কিছু আমরা জানি, কিছু জানি না। কিন্তু তা হচ্ছে খুব সীমিত পরিসরে। তবে এ-লেখায় অরবিন্দের ওই পন্ডিচেরী-বাসের সূত্রে অন্তত একটা বিষয় আলোচনা জরুরি। 


তা হল নিভৃতবাস। 'কোয়ারান্টিন' শব্দটির অস্তিত্ব সভ্যতার-ইতিহাসে যত আগে থেকেই থেকে থাক, এই করোনা-বিশ্বই যে শব্দটিকে বিশেষ তাত্‍পর্যবাহী করে তুলল, এ বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু নিজের জীবনে সেই কত-কত দিন আগে শ্রীঅরবিন্দ ডেকে নিয়েছিলেন সাধনগূঢ় এই নিভৃতবাসকে। জীবনের শেষ ৪০টি বছর অরবিন্দ পন্ডিচেরিতে অতিবাহিত করেন। এর মধ্যে অন্তত ২৪ বছর, টানা দু'যুগ তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছা-কোয়ারান্টিনে আবদ্ধ রেখেছিলেন। বাঙালি তথা ভারতীয় জীবনে এমন উদাহরণ বিরল! 


১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তার আগে, ক্রমশই নির্জন হচ্ছেন সাধক-কবি অরবিন্দ; ক্রমশই ডুবে যাচ্ছেন মানব-উত্তরণের পন্থা-সন্ধানী সুগভীর ধ্যানে; ক্রমশই রচনা করছেন আত্মশাসনের এক সমুজ্জ্বল কাব্য। ওই নিভৃতবাস-পর্বেই গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি অরবিন্দ ধর্ম, দর্শন ও ভারতীয় সংস্কৃতির উপর বহু-বহু গ্রন্থ রচনা করছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকখানি: Essays on the Gita, The Foundations of Indian Culture, The Life Divine (১৯৩৯), Savitri (১৯৫০), Mother India, The Significance of Indian Art, Lights on Yoga, A System of National Education, The Renaissance in India! অতলান্ত  মেধা-মনন-অনুভূতির শেষ নেই!


দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর হয়ে আলিপুর বোমা মামলা লড়ার সময়ে সওয়াল-জবাবের সূত্রে আদালতে দাঁড়িয়ে অরবিন্দকে 'জাতীয়তাবাদের দ্রষ্টা এবং দেশপ্রেমের কবি' (prophet of nationalism and poet of patriotism) বলে চিহ্নিত করেছিলেন! ঠিকই বলেছিলেন। তবে হয়তো একটু কম বলেছিলেন। অবশ্য যে-অরবিন্দকে এখন আমরা দেখছি-জানছি-বুঝতে চাইছি, সেই-অরবিন্দ থেকে সেদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা 'দেশদ্রোহী' অরবিন্দ অনেক দূরের গ্রহের মানুষ ছিলেন। এই-অরবিন্দকে দেখার-জানার সুযোগ পেলে দেশবন্ধু নিশ্চয়ই তাঁকে আর শুধু 'জাতীয়তাবাদের দ্রষ্টা এবং দেশপ্রেমের কবি' বলেই ক্ষান্ত হতেন না; হয়তো বলতেন, অরবিন্দ মানবসভ্যতার নিভৃতসাধনার ইতিহাসে এক বিরলমাপের মহাকবি!


কেননা অরবিন্দ তাঁর অন্ত্য-জীবনলীলা দিয়ে রচনা করেছেন আত্মশাসনের এক সমুজ্জ্বল কাব্য! তার সুষমা আজও  স্তম্ভিত করে আমাদের, বিস্মিত করে!


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: Rash Behari Bose: শুধু বিপ্লবী হিসেবেই নন, জাপানে রাসবিহারী খ্যাত Indian Curry-র জন্যও!