অমরকণ্টক - এক মায়াময় অধ্যাত্মভূমি
নিজস্ব প্রতিবেদন : একদিকে সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বত। মাঝে মেখল পাহাড়ের চূড়ায় পুণ্যতোয়া নর্মদার তটে পুণ্যতীর্থ অমরকণ্টক। রামায়ণ মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, এমনকি মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত, সর্বত্রই এই অমরকণ্টকের নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা বলা হয়েছে। সতীপীঠ পরিক্রমায় অমরকণ্টকে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মা নর্মদার কারণে।
"মেঘ! এই যে আম্রকূট পর্বতের কথা কহিলাম, ও শুধু নামে নহে, সত্যিই ওর শিখর দেশটি আমগাছে ভরা। তাই ওর নাম আম্রকূট। মেঘ! তেল কুচকুচে মিশমিশে কালো চুলের বেণীর মতো তোমার রঙ। তুমি গিয়া যখন ওই পাণ্ডুবর্ণ নৈবেদ্যকার শৃঙ্গের ওপর বসিবে, তখন আকাশ হইতে দেবদম্পতিরা নীচের দিকে চাহিলেই দেখিবেন, যেন ধরণী সুন্দরীর পীন পয়োধর শোভা পাইতেছে।''
অলকাপুরীতে নির্বাসিত যক্ষ বিরহে কাতর। মেঘকে অনুরোধ করেছেন পত্নীর খবর নিতে। মহাকবি কালিদাস তাঁর বর্ণনায় আশ্চর্য সুন্দর ছবি এঁকেছেন নর্মদার উত্সমুখ অমরকণ্টক পর্বতের। পাহাড়ি পথের দুধারে অজস্র গাছ। এপথের আকর্ষণই আলাদা। গিরিখাদ আর গাছগাছালির বিচিত্র বিন্যাস, বাতাসের গুনগুনানি, মহুয়ার নেশার মতো মাতাল করে দেয়।
গোটা অমরকন্টক মন্দিরময়। সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হল এই মা নর্মদার মন্দির। এই মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে নর্মদা নদীর উত্সস্থলে। এখান থেকেই সামগ্রিক মহিমা। বহু প্রাচীন বিন্ধ্য পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ হল অমরকণ্টক। এখন থেকেই পৌরাণিক নদী নর্মদার যাত্রা শুরু। উদগমস্থল দিব্যতীর্থ হিসেবে মানা হয়। শাক্ত গ্রন্থ অনুযায়ী, চণ্ডিকা পীঠ নামে খ্যাত। গঙ্গা উপাসনার নদী, সরস্বতী জ্ঞানের নদী, নর্মদা তপস্যার নদী। শিবের তপস্যা সাক্ষাত্ নর্মদা হিসেবে উঠে এসেছে।
শত শত বছর ধরে কুণ্ডে উঠে আসা জল বেরনোর জন্য রয়েছে একটি নালার সংযোগ। এর নাম গোমুখনালা। গোমুখনালার ভিতর দিয়ে নর্মদা এসে পড়েছে কোটি তীর্থে। পুরাণ অনুযায়ী শিব বিষ পান করলেন। বিষেয় জ্বালায় ছটফট। অমরকণ্টকে এসে জ্বালা জুড়োল। দেখলেন সবাই ধ্যান করছে। শিব ৫ হাজার বছর ধ্যানে বসলেন। গলার ঘাম থেকে সৃষ্টি হল নর্মদার। মহাদেব চোখ খুলে তাঁকে দেখে প্রসন্ন হলেন। স্বয়ং মহাদেবের তপস্যার ফল নর্মদা। এই সতীপীঠের মাহাত্ম্য অনেক।
কথিত আছে, নর্মদার উত্সমুখের সন্ধান পান মরাঠা রাজা প্রথম বাজীরাও। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বিশেষ পরিচিতি পায় এই তীর্থ। অমরকণ্টক সাধন তীর্থ। কথিত আছে, কপট পাশাখেলায় হারের ক্ষত জুড়োতে নর্মদার তীরে ধ্যান করেছিলেন প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। পুরাণ বলে, নারদ, বশিষ্ঠ, কপিল, ভৃগু, দুর্বাসার মতো মহান মুনি ঋষিরা তপস্যা করেছেন নর্মদা তীর্থ অমরকণ্টকে।
ঝাউ, পাইন, শাল, সেগুনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই কপিলধারায় পৌছে যাওয়া। গেলাম নর্মদা, মন্দির থেকে বেরনোর পর প্রথম ধারা এখানে পড়েছে পাহাড়ি খাদে। কয়েকশো ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে জলধারা। কিশোরী যেন প্রথম যৌবনে পা দিয়েছে কপিলধারায় এসে। মা নর্মদার প্রতিটি কাঁকড়ই হল শঙ্কর। এই হল কপিলধারা। ওপর থেকে নর্মদা ঝরে পড়ছে সশব্দে। আর এই গহন অরণ্যে জলপ্রপাতের সামনে বসে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন কপিলমুণি। তা থেকে জলপ্রপাতের নাম কপিলধারা। অমরকণ্টকে এসে কপিলধারা দর্শন করলে মোক্ষলাভ হয়। এমনই জনশ্রুতি।
অশ্বত্থা সর্ববৃক্ষাণাং ... সিদ্ধানাম কপিলৌ মুনি -- কৃষ্ণও বলেছেন একই কথা। বারবার প্রয়াগ গিয়েও সেই পুণ্য হয় না, একবার অমরকণ্টক আর কপিলধারা দর্শন করলে যা হয়। পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ার পর, নর্মদার জল সরু ধারা হয়ে বয়ে গিয়েছে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পুণ্যলোভীদের অনেকেই স্নান করেন এই জলধারায়। কপিলধারার উল্লেখ আছে স্কন্দ পুরাণে। মাথা উঁচু করে জেগে মৌন পর্বত, একেবারে ধ্যানস্তব্ধ। কপিলধারার বিরামহীন ধারাপাত। সব মিলিয়ে অমরকণ্টক এক মায়াময় অধ্যাত্মভূমি।
নর্মদা সমস্ত নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর অমরকণ্টক হল একাধারে শৈব পীঠ, তন্ত্র পীঠ ও অঘোর পীঠ। তপস্যার উত্তম ভূমি নর্মদা তট। এখানে তপস্যা করলে, অন্য যে কোনও স্থানে তপস্যার চেয়ে অধিক ও দ্রুত ফল লাভ হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত মুনি-ঋষি সাধনক্ষেত্রে হিসেবে নর্মদা তটকে বেছে নিয়েছেন। তার অন্যতম কারণ এর শক্তি মাহাত্ম্য।
নর্মদা মন্দির থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে শোনমূঢ়া। এখানে শোন নদীর উত্পত্তিস্থলে গড়ে উঠেছে দেবী শোনাক্ষীর মন্দির, যা একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ। দক্ষযজ্ঞে সতীর প্রাণত্যাগের পর, মহাদেব যখন তাঁকে কাঁধে নিয়ে জগত্ পরিভ্রমণ করছেন, তখন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করেন। দেবীর দেহের বিভিন্ন অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে, সেখানে গড়ে উঠেছে মহাশক্তিপীঠ। কথিত আছে, শোনমূঢ়ায় দেবীর বাম নিতম্ব পড়েছিল।
যেখানে সতী, সেখানেই শিব। শোনাক্ষী দেবীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে শিবলিঙ্গ। শঙ্কর এখানে মহাকাল ভদ্রসেন নামে পূজিত হন। সতীপীঠের স্থান নির্বাচন নিয়ে মতভেদ যাই থাক না কেন, অমরকণ্টকের স্থান মাহাত্ম্য নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তীর্থভূমি ভারতের বুকে এই জায়গাখানি সাধু, সন্ত, মহাত্মা, তীর্থ অভিলাষীদের যুগ যুগ ধরে আহ্বান করে চলেছে।
লিঙ্গরূপেণ সুচিরং প্লবয়ামি তব ক্রোড়ে -শিবলিঙ্গ হয়ে কন্যার কোলে তিনি নিত্যকাল ভেসে বেড়াবেন। মেয়ে নর্মদাকে নাকি এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভগবান শঙ্কর। নর্মদার বুকের সব পাথরই তাই শিব। কালের স্রোতে আমরা প্রত্যেকেই ভেসে চলেছি। কবে কোথায় কোন কূলে গিয়ে ঠেকব, কেউ জানি না। ক্ষণিকের বুদবুদের মতো জীবনে এই শিবময় মাতৃভূমিকে কোটি কোটি প্রণাম।