অনেকটা ওই `মন রে কৃষিকাজ জানো না`, বলে যেন কৃষি বিল পাশ করাল কেন্দ্র! বিরোধীরা কি তবে সরকারের চোখে `পতিত মানবজমিন`?
নিজস্ব প্রতিবেদন: কৃষিবিল কী এবং কেন? বিরোধীদের আপত্তি কীসে? সত্যিই কি বিপদে কৃষকেরা?
চলতি বছরের জুন মাসে কৃষি বিপণনে তিনটি অর্ডিন্যান্স এনেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তখনই বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিল, রাজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং কৃষককে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সঙ্কটের মুখে। ৩টি অর্ডিন্যান্সকে আইনি রূপ দেওয়ার জন্য সংসদের অধিবেশনে তিনটি বিল পেশ এবং পাশ করানোও হয়েছে। দেশ জুড়ে এই বিল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেই ঘোলাজলে মাছ ধরছেন। এই অবসরে দেখা যাক, কৃষি বিল বিষয়টি ঠিক কী? এবং তাতে বিরোধীদের বক্তব্যই-বা কেমন?
যে তিনটি বিল নিয়ে দেশ উত্তপ্ত সেগুলি হল যথাক্রমে, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন, কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন, কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি।
১৯৫৬ সালের অত্যাবশ্যক পণ্য আইনটির সংশোধনে বলা হয়েছে চাল, ডাল, গম, আলু, তৈলবীজ, পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য মজুতে আর কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না। সরকারের যুক্তি, দেশে এখন কৃষির উত্পাদন যথেষ্ট। মজুতে কোনও বাধা না থাকায় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও গতি আসবে। বিরোধীদের অভিযোগ, যত খুশি মজুতের অধিকার দেওয়া হলে কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে ও কালোবাজারির রাস্তা খুলে যাবে।
কৃষিপণ্যের মুক্ত বাজার আইনে বলা হয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে কৃষিপণ্য বাজার কমিটি অর্থাত্, এপিএমসি-র নিয়ন্ত্রণে থাকা মান্ডির বাইরেও কৃষক ইচ্ছামতো ফসল বিক্রি করতে পারবেন। তৈরি হবে এক দেশ, এক কৃষি বাজার। সরকারের যুক্তি, এর ফলে কৃষক ফসলের উপযুক্ত দাম পাবেন এবং কৃষিভিত্তিক ব্যবসায়ে বড় লগ্নিও আসবে। বিরোধীদের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে দর কষাকষিতে পেরে না উঠতে পারলে আখেরে কৃষকেরই ক্ষতি হবে।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে চাষির কাছ থেকে ফসল কেনাও তুলে দিতে পারে সরকার। নতুন চুক্তিচাষ আইনে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কৃষকের চুক্তির নানা দিক নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, যাতে কৃষককে ঠকতে না হয়। সরকারের যুক্তি, এর ফলে কৃষিতে বড় পুঁজি আসবে। ফসল রোপণের সময়েই কৃষক জেনে যাবেন, তিনি কী দাম পাবেন। বিরোধীদের অভিযোগ, শুরুতে কৃষকের কিছুটা লাভ হলেও বিগ কর্পোরেটের একচেটিয়া কারবারে তাঁরা বঞ্চিতই হবেন।
২০১৫ সালে সরকার নিযুক্ত শান্তা কুমার কমিটি সুপারিশ করে, এফসিআইয়ের মাধ্যমে ফসল কেনা বন্ধ করুক সরকার। মাত্র ছ' শতাংশ চাষি এর সুবিধা পান। তাই এমএসপি-ও তুলে দেওয়া হোক। বিরোধীদের আশঙ্কা, নতুন তিন আইন চালু হওয়ার পর এই পথেই হাঁটতে
পারে সরকার।
পঞ্জাব-হরিয়ানায় কমিশন এজেন্টরা সরকারি মান্ডিতে ফসল কেনার সময় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকেন। তাঁরা আড়াই শতাংশ কমিশন পান। পঞ্জাব সরকারও এফসিআই-এর থেকে ছ'শতাংশ কমিশন পায়। ফলে, নতুন ব্যবস্থায় স্বার্থে আঘাত লাগার আশঙ্কায়, এই দু'রাজ্যেই কৃষকদের ক্ষোভের তীব্রতা বেশি।
সংসদে প্রায় ১১টি বিরোধীদল এই বিলের বিরোধিতা করে। বিরোধীদের প্রধান আপত্তি, চাষিরা সরকারি মান্ডির বাইরে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে ফসল বিক্রি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বা তার চেয়ে বেশি দরে ফসল কিনতে বাধ্য থাকবে, এমন কোনও শর্তের কথা কেন বিলে কোথাও নেই! এই বিলের জেরে কৃষক আত্মহত্যাও বেড়ে যাবে বলে বিরোধীদের ধারণা। বিরোধীরা একযোগে দাবি তুলেছিলেন, বিলগুলি সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। কিন্তু মোদী সরকার চলতি অধিবেশনেই বিল পাশ করাতে অনড় মনোভাব নেয়। যা মোটেই ভাল ভাবে নেয়নি বিরোধীরা। বিতর্ক তরান্বিত হয় অকালি দলের হরসিমরত কউর মোদী সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ায়। লোকসভার পরে রাজ্যসভাতেও বিল পাশ করাতে সক্ষম হয় কেন্দ্র সরকার। রাজ্যসভায় বিল পাশ হয় ধ্বনিভোটে। যা নিয়ে বিরোধীরা আর এক চোট প্রতিবাদ জানান।
পরে প্রধানমন্ত্রী টুইট করেন, এটি কৃষিতে যুগান্তকারী এক মুহূর্ত। এর ফলে কৃষকদের সক্ষমতা আসবে, তাঁরা ফড়েদের থেকে মুক্তি পাবেন। উত্পাদনও বাড়বে। আশ্বাস দেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যেই সরকারের ফসল কেনার ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
রাহুলের পাল্টা টুইট, এটি কালা কানুন। এপিএমসি বা কিষাণ বাজার শেষ হয়ে গেলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কীভাবে মিলবে? মোদীজি কৃষককে পুঁজিপতিদের গোলাম বানাতে চাইছেন।
তৃণমূলের তরফে বলা হয়, স্বৈরতান্ত্রিক বিজেপি সরকার সংসদ, গণতন্ত্র, সংবিধানের মতো সব প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংস করছে।
কৃষি বিলের প্রতিবাদে পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানে পথে নামেন কৃষকেরা। পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানায় আম্বালা-মোহালি হাইওয়ে অবরোধ করা হলে জলকামান চালায় পুলিশ। চলতি সপ্তাহের শেষে বাংলাতেও এ নিয়ে প্রতিবাদের পরিকল্পনা প্রস্তুত।