``ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট কী জিনিস, দেখালেন নোবেলজয়ী অভিজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়``
শুভাশীষ মোদক চৌধুরী
শুভাশীষ মোদক চৌধুরী
(ইউনিভার্সিটি অফ বাথ-এর অর্থনীতির অধ্যাপক)
এবারের অর্থনীতির নোবেল অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় (এস্থার ডাফলো, এবং মাইকেল ক্রেমার এর সঙ্গে ভাগ করে) পাওয়ায় বাঙালি দারুণ খুশি! সবাই মোটামুটি জেনেও গিয়েছেন, ওনাদের কী কারণে নোবেল দেওয়া হল! ওনারা কে কী করেন ইত্যাদি। আমি তাই ওসব বিষয় নিয়ে আর কিছু বলতে চাইনা। তবে এবারের নোবেল এবং নোবেলজয়ীদের সম্পর্কে দু-একটা কথা, যা সাধারণ ভাবে মিডিয়াতে আসে না, সেগুলো জানাতেই এই লেখা। প্রথমত, এবারের নোবেল ফিল্ড-এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে: এই ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট জিনিসটা কী, তা একটু বলার চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, অভিজিৎবাবুর কথা এর মধ্যেই অনেকে জেনে গেলেও তাঁর স্ত্রী এস্থার সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা চোখে পড়েনি। এখানে ওঁকে নিয়েও কিছু কথা জানাতে চাই।
আরও পড়ুন- ‘ডুবে মরো’, সাভারকারকে ‘ভারত রত্ন’ না দিয়ে অপমান করা হয়েছে, তোপ নরেন্দ্র মোদীর
অর্থনীতি বিষয়টা ঠিক অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো নয়। পদার্থবিদ্যা বা রসায়নে যেভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব, আগে অর্থনীতিতে সেভাবে এক্সপেরিমেন্ট হত না। মানুষ কীভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা আগে শুধুই বাজার থেকে তথ্য সংগ্ৰহ করে বাজিয়ে দেখা হত। যেমন - কোনও জিনিসের দাম বাড়লে মানুষ কী সেটা কম কিনবে না বেশি? সাধারণ বুদ্ধি এবং অর্থনীতির তত্ত্ব দুই-ই বলে যে দাম বাড়লে মানুষের কম কেনা উচিত। কিন্তু সত্যি সত্যি সেটা হয় কিনা দেখতে গেলে নানা সময়ে সেই জিনিসের কী দাম ছিল এবং কতটা বিক্রি হয়েছে, সেই তথ্য নিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। তবে বাজার থেকে তথ্য সংগ্ৰহ করলে অনেক ক্ষেত্রেই দাম ও চাহিদার সরাসরি যোগাযোগ পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ যে কিনছে তার হয়তো রোজগার বেড়ে গেল। তাই দাম বাড়া সত্ত্বেও সে বেশি কিনতে পারে! অবশ্য, যদি মানুষ-জনকে ল্যাবরেটরিতে এনে তাদের জিনিসের দাম অনুযায়ী কেনার প্রবণতা তথ্য সংগ্ৰহ করা যায়, তবে এই অসুবিধে থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে; কারণ ল্যাবরেটরিতে আয় বাড়া-কমা নিয়ে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে তাই বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ নানা বিষয় নিয়ে ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করেন। ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য ভারনন স্মিথ ২০০২ সালে নোবেল পান। কিন্তু বড়সড় পলিসি বদলের (যেমন নোটবন্দি) ফল কী হতে পারে তা ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্ট করে বোঝা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে সেই এক্সপেরিমেন্ট করতে হয় ল্যাবরেটরির বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেই। যেমন ধরা যাক, গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিলে তাদের বেশি উপকার হবে নাকি খাবারের কুপন দিলে! সেটা জানা যাবে কিছু মানুষের হাতে টাকা এবং কিছু মানুষের হাতে খাবারের কুপন দিয়ে তাদের ওপর বেশ কয়েক মাস লক্ষ্য রাখলে। এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টকেই বলে ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট- যা এবারের নোবেল জয়ীরা করেছেন।
অভিজিৎবাবু, অথবা মাইকেল ক্রেমার কেউই শুরু থেকে এক্সপেরিমেন্ট করেননি। ওনাদের কাজ শুরু তাত্ত্বিক অর্থনীতির ওপর। অভিজিৎবাবু ইনফরমেশন ইকোনোমিক্স আর ক্রেমার ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিক্স নিয়ে কাজ করতেন। ক্রেমারের তৈরী 'ও-রিং থিওরি' আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। যদিও ওর সাথে ওনার নোবেল সম্পর্কিত গবেষণার কোনও সংযোগ নেই! এস্থার শুরু থেকেই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কাজ করতেন। তবে মজার ঘটনা হল, উনি প্রথমে অর্থনীতি নিয়ে পড়তেই চাননি। উনি গবেষণা শুরু করেন ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু এক সময় মনে হয় ইতিহাসের থেকে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করলে মানুষের জন্য বেশি কাজ করা যাবে। ভাগ্যিস ভেবেছিলেন, তাই আমরা আজ পেলাম এই নোবেল বিজয়িনীকে!
এস্থারের নোবেল জয়ের সঙ্গে বেশ কিছু রেকর্ড তৈরী হল। এখনও পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী মিলে নোবেল পেয়েছেন ৫ দম্পতি। ম্যাডাম কুরী আর পিয়েরে কুরীর কথা তো মোটামুটি আমরা জানিই। প্রয়াত অর্থনীতিবিদ গুনার মির্ডাল এবং তার স্ত্রী আলভা মির্ডাল নোবেল জয়ী। কিন্তু আলভা নোবেল পান শান্তিতে, তাই অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী দম্পতি এস্থার-অভিজিৎই প্রথম! এস্থার নোবেল জিতলেন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে! অর্থনীতিতে এতো কম বয়সে নোবেল আগে কেউ পায়নি। সাধারণত অর্থনীতিবিদদের তত্ত্ব কাজ করছে কিনা মিলিয়ে দেখতে অনেক সময় লাগে। ফলে কম বয়সের গবেষণার জন্য নোবেল পেতে সাধারণত গবেষকদের অপেক্ষা করতে হয় ষাট-সত্তর বছর বয়স অবধি (হরোইজ নোবেল পান ৯০ বছর বয়সে!)। এস্থারদের গবেষণা যেহেতু পলিসি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, তাই গবেষণার ফল খুব তাড়াতাড়িই দেখতে পাওয়া গিয়েছে। অসাধারন গবেষণা এবং তাড়াতাড়ি ফল দেখতে পাওয়া - দুই মিলিয়ে এতো কম বয়সে এস্থারের নোবেল জয়! এটাও উল্লেখযোগ্য যে অর্থনীতির নোবেলের ৫০ বছরের ইতিহাসে এস্থার মাত্র দ্বিতীয় মহিলা যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন। এর আগে ২০০৯ এ ইলিনর অস্ট্রম নোবেল পেয়েছিলেন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কাজ করার জন্যই! এস্থার আশা করছেন, ওনার এই নোবেল জয় অন্য মেয়েদেরও এই বিষয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করবে!
লেখাটা শেষ করব একটা মজার গল্প দিয়ে। অভিজিৎবাবু প্রথম জীবনে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী প্রফেসর ডেভিড কুপার সেই সময় ওখানে পিএইচডি করছিলেন -গল্পটা ওনার থেকেই শোনা! অভিজিৎবাবু এবং ডেভিড অর্থনীতির এক জটিল তত্ত্ব সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই করে উঠতে পারছিলেন না। শেষে বিরক্ত হয়ে অভিজিৎবাবু ডেভিডকে বলেন - এই তত্ত্ব আমার দ্বারা সমাধান হবে না। আমাকে দিয়ে গবেষণার কোনও কাজই হবে না .. ইত্যাদি। এই ঘটনার ঠিক ২৮ বছর পর তিনিই নোবেল পেলেন!