দিল্লির উপরাজ্যপাল নিয়ে `সুপ্রিম` রায়ে বিরোধীদের অক্সিজেন?
রাজ্যপালের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করছে বিজেপি বলে প্রায়ই অভিযোগ বিরোধীদের।
জ্যোর্তিময় কর্মকার
রাজধানীতে কেজরিওয়াল-উপরাজ্যপাল সংঘাত মামলায় বুধবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কি 'প্যান্ডোরার বাক্স' খুলে দিল? দিল্লিবাসীর নির্বাচিত সরকারের হাতে শাসনক্ষমতা থাকবে বলে স্পষ্ট জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। বস্তুত ভারতীয় রাজনীতিতে নির্বাচিত সরকার ও রাজ্যপালের বিবাদ এটাই প্রথম নয়! এর আগেও এমন সাংবিধানিক সংকট দেখেছে দেশ। রাজ্যপালের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করছে বিজেপি বলে প্রায়ই অভিযোগ করছে বিরোধীরা। এদিন সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই বিবাদ আরও খানিকটা উস্কে দিল আর ভবিষ্যতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের বাড়তি অক্সিজেনও দিল এই 'সুপ্রিম' রায়।
অতিসম্প্রতি কর্ণাটকে রাজ্যপালের ক্ষমতার অব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করেছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছেন রাজ্যপাল বাজুভাই বালা।সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ইয়েদুরাপ্পাকে ১৫দিনের সময় দিয়েছিলেন কর্ণাটকের রাজ্যপাল। যিনি আবার এককালে গুজরাট বিজেপির রাজ্য সভাপতি ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সে যাত্রায় বিরোধীদের মুখে হাসি ফোটে। অরুণাচলে আবার রাজ্যপালের মাধ্যমে কলকাটি নেড়ে সরকার ফেলার অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। গোয়া ও মণিপুরে রাজ্যপালের মাধ্যমেই প্রভাব খাটিয়ে সরকার গঠনের অভিযোগে কাঠগড়ায় কেন্দ্রের শাসক দল। এমনকি বিহারেও তাত্পর্যপূর্ণভাবে নীতীশের ইস্তফার দিন পটনায় হাজির ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। বিরোধীরা অভিযোগ করেছিল, বিজেপি-জেডিইউ সমঝোতা অনেক আগে থেকেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। সাংবিধানিক পদের গরিমা ভেঙে সম্প্রতি এক বিজেপি বিধায়ককে পরামর্শ দিতে শোনা গিয়েছে মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দিবেন পটেলকে। কয়েকবছর আগেও তিনি ছিলেন গুজরাটের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গও বা বাদ যায় কেন! এরাজ্যেও রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মধ্যে মাঝেমধ্যেই এক্তিয়ার নিয়ে চলেছে তরজা।আরএসএস অতীতের প্রসঙ্গ টেনে কেশরীনাথকে নিশানাও করেছেন তৃণমূল নেতারা। লোকসভা ও রাজ্যসভায় ২বার এবিষয়ে আলোচনা চেয়ে মুলতবি প্রস্তাব আনতে চেয়েছিল তৃণমূল।
দিল্লিতে দু'সপ্তাহ আগে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে অনশনে বসেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। অনশনরত কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনরাই বিজয়নদের। এর পিছনেও দলীয় রাজনীতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল আপ। প্রাক্তন উপরাজ্যপাল নজীব জঙ্গ থেকে বর্তমানে অনিল বৈজল- সকলেই নির্বাচিত সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের। তাঁর দাবি, আসলে উপরাজ্যপালের মাধ্যমেই দিল্লিতে রাজ করেন মোদী। বুধবার দিল্লি সরকারের উপরেই আস্থা রাখল সুপ্রিম কোর্ট।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ নিয়ে খুব বেশি সোচ্চার হওয়া কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। রাজ্যে রাজ্যে পছন্দের লোককে রাজ্যপালের কুর্সিতে বসানোর রীতি শুরু করেছিল কংগ্রেসই, মত রাজনীতির কারবারিদের। তাদের দেখানো পথেই চলছে বিজেপি। ১৯৮২ সালে হরিয়ানায় তত্কালীন লোকদল ও বিজেপিকে সরকার থেকে ব্রাত্য করেছিলেন কংগ্রেসি রাজ্যপাল গানপাত্রো দেবজি তাপসি। ১৯৯৮ সালে কল্যাণ সিংয়ের বিজেপি সরকারকে বরখাস্ত করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল রমেশ ভান্ডারি। গান্ধী ও নেহরু পরিবারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাতের এমন নজির ভুরি ভুরি রয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে।
তবে এদিন যেভাবে উপরাজ্যপালের উপরে রাশ টানল আদালত, তা নিশ্চিতভাবেই নয়া দিগন্তের সূচনার ইঙ্গিত দিল। ২০১৯ সালের আগে বিরোধী দলগুলির মধ্যেও সঞ্চার করল বাড়তি অক্সিজেন। এনিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধীরাও এবার আদালতের দরজায় টোকা দিতে পারবেন বলে মত রাজনৈতিক মহলের। অনেকেই আবার বলছেন, এই রায়ের পর সেই প্রশ্নটা আবার ঘুরে ফিরে আসতে বাধ্য, আদৌ কি আর রাজ্যপাল পদের কোনও যৌক্তিকতা রয়েছে?
আরও পড়ুন- দিল্লির 'প্রকৃত' ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের হাতে, উপ-রাজ্যপাল 'বাধা' সৃষ্টি করতে পারেন না