Durga Puja 2021: প্রায় তিনশোয় পা দাঁতনের `মহামারী` দুর্গাপুজোর
কামানের তোপ নেই, নেই হাজার টাকার ঝাড়বাতির রোশনাই, তবু অটুট পরম্পরা। সেই পরম্পরা মেনেই দাঁতনের আঙ্গুয়া দাস মহাপাত্র জমিদার বাড়িতে আজও পুজো হচ্ছে। প্রায় ২৮০ বছর আগে এ পুজোর সূচনা। সেই সময় কলেরা ও বসন্তের প্রাদুর্ভাব ছিল বঙ্গদেশে। মা উমা সেই দুর্গতি সংহার করবেন এই বিশ্বাসেই শুরু এই মহামারী পুজো। এখনও হয় মহামারী পুজো।
এ পুজোর একেবারে শুরুতে এখানে ঘট পুজো হত। পরে শুরু পটপুজোর। তারও পরে এসেছে মূর্তি। সেখানেও বিশেষত্ব আছে। বৈষ্ণব আদলে তৈরি মূর্তিকে শাক্তমতে পুজো করা হয় এই বাড়িতে। পারিবারিক ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৭৪০-৪২ নাগাদ বর্গী আক্রমণে ওড়িশার (তখন কলিঙ্গ) খুড়দা থেকে নিরাপদ জায়গা জলেশ্বর পরগনায় চলে আসেন পরিবারের পূর্বপুরুষ বিরিঞ্চি মহান্তি। থাকতেন দাঁতনের পলাশিয়াতে। এক বাঙালি ব্রাহ্মণ জমিদারের মেয়েকে পড়ানো শুরু করেন বিরিঞ্চি। সঙ্গে জমিদারিও দেখাশোনা করতেন। সেই ব্রাহ্মণের থেকেই জমিদারির অংশ পেয়েছিলেন। আর ব্রাহ্মণ জমিদার কাশীযাত্রা করেন। এর পরেই প্রভাব বাড়তে শুরু করে বিরিঞ্চির। ক্রমে শুরু হয় দুর্গোৎসব। গোড়ায় ঘট পুজো। পরে বাংলার মসনদ নবাব আলীবর্দী খান তৎকালীন জমিদার রূপনারায়ণ দাস মহাপাত্র হাতধরে পট পুজোর সূচনা করেন। পরবর্তীতে চৌধুরী যাদবেন্দ্রনাথ দাস মহাপাত্র মূর্তি পুজোর প্রচলন করেন।
'মহান্তি' থেকে 'দাস মহাপাত্র' হওয়ারও কাহিনি আছে। ধর্মকর্মে মতির পাশাপাশি শিক্ষাতেও উন্নত ছিল এই পরিবার। কায়স্থ করণবংশীয় বিরিঞ্চি মহান্তি জমিদারের প্রধান কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। এই দায়িত্ব যাঁরা পালন করতেন তাঁদের বলা হত 'মহামাত্য'। অপভ্রংশে 'মহামাত্য'ই একদা 'মহামাত্র' এবং তা থেকে ক্রমে 'মহাপাত্র' হয়েছে। নামে কায়স্থ পরিচয়ের প্রাধান্য দিতে পদবিতে 'দাস'ও ব্যবহার করতেন এঁরা। রাজা বা জমিদারের অনুগত বলেও 'দাস' ব্যবহৃত হতে পারে বলে অনুমান কারও কারও। আবার ব্রিটিশদের থেকে জুটেছিল 'চৌধুরী' উপাধিও।
সাবেক আমলে এই পুজোয় চণ্ডীমঙ্গল গান হত। এখানে এখনও শিবায়ন গান হয়। বসে যাত্রার আসর। প্রথা মেনে জমিদারের তরবারি নিয়ে ঘটোত্তোলনে যাওয়া হয়। প্রতিপদে ঘট তুলে শুরু হয় পুজো। দেবীর চক্ষুদানের সময় এখনও চালকুমড়ো বলি দেওয়ার রীতি আছে। বিশ্বাস, জড়কে বলি দিয়ে প্রাণের স্পন্দন জাগানো। এ পুজোয় প্রতিদিনই চালকুমড়োর বলি হয়-- সপ্তমীতে সাত, অষ্টমীতে আট, নবমীতে নয় ও দশমীতে একটি করে। নবমীতে এলাকার অনেকেই পুজোয় মানত করেন, বলির জন্যে চালকুমড়ো দেন।
এই পুজোর বিশেষত্ব, পুজোর একমাস আগে থেকেই পরিবারের গৃহবধূরা তৈরি করেন খইয়ের মুড়কি। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রায় ১ কুইন্টাল কুড়ি কেজি খইয়ের মুড়কি লাগে। পুজোর পরে এই মুড়কি পরিবারের কেউই খান না। দর্শনার্থী ও গ্রামবাসীদের প্রতিদিন মুড়ি বিলি করা হয়।
পুরনো আমলের আতস কাচ ধরে সূর্যের আলো থেকে নেওয়া আগুন এবং তা থেকেই করা হয় হোম। না হলে 'অগ্নিহোত্রী' ব্রাহ্মণের বাড়ি থেকে আনা হয় আগুন। আগে হোমে এক মণ ঘি পোড়ানো হত। এখন একুশ কেজি। এ পুজোয় উমাকে বরণ করা হয় কন্যা হিসেবে, যদিও মাতৃরূপেই পুজো। দশমীতে রাবণবধও হয়।
জমিদারি নেই, নেই ঠাটবাটও। তবে দুর্গামণ্ডপের সামনে সিংহদুয়ার পুরনো জৌলুস মনে করিয়ে দেয়। বহু মানুষের সমাগম ঘটে পুজোয়। পরিবারের এক সদস্য চন্দন দাস মহাপাত্র বলেন-- শুনেছি, বহু বছর আগে এখানে কলেরা, ডায়েরিয়া-সহ নানা অসুখ-বিসুখ হত। তখন পূর্বপুরুষরা ভাবলেন, মায়ের কাছে মহামারী নিবারণের প্রার্থনা করে পুজো করলে মানুষের মঙ্গল হবে। সেইমতো এখনও এ রীতি চলে আসছে।