সুদূর উনিশ শতকেই নারীকণ্ঠের অনন্য জয়গান গীত হয়েছিল কাদম্বিনী-কাব্যে
হতে পারে সেটা উনিশ শতক। হতে পারে নবজাগরণের লগ্ন। কিন্তু তখনও সব অন্ধকার কাটেনি। তখনও নারীর জয়গান সর্বত্র গীত হতে শুরু করেনি। তখনও নারীর চলার পথে প্রভূত বাধা। এরকম কত বাধা, কত সঙ্কট পেরিয়ে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি 'কাদম্বিনী গাঙ্গুলি' হলেন। ইদানীংকার দু'টি বাংলা টেলিসিরিয়ালের জেরে কাদম্বিনী হয়তো এখন একটা 'হাউসহোল্ড নেম'-এ পরিণত হয়েছেন। না হলে এ কালের নব্য প্রজন্ম কি সে ভাবে মনে রেখেছে তাঁকে?
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুই নারী স্নাতকের একজন তিনি। ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসকও তিনি। উনিশ শতকের শেষভাগে পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন কাদম্বিনী। আনন্দীবাঈ জোশীর সঙ্গে তিনিও হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথমদিকের এক নারী চিকিৎসক। ব্রাহ্ম-সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনীর জন্ম হয় ১৮ই জুলাই ১৮৬১ তে বিহারের ভাগলপুরে। তাঁদের মূল বাড়ি ছিল বরিশালের চাঁদশিতে। তাঁর বাবা ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
স্কুলে পড়ার সময়ে কাদম্বিনী ১৮৭৮ সালে প্রথম মহিলা হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। অনেকটা তাঁর সাফল্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বেথুন কলেজ প্রথম এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং তারপর অন্যান্য স্নাতক শ্রেণি আরম্ভ করে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। তাঁরা বি.এ পাস করেছিলেন। তারা ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট।
গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নেন তিনি ডাক্তারি পড়বেন। ১৮৮৩ সালে মেডিকেল কলেজে ঢোকার পরে একুশের কাদম্বিনী তাঁর শিক্ষক ৩৯ বছরের দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে বিয়ে করেন। দ্বারকানাথ বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও মানবদরদি সাংবাদিক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন।
কাদম্বিনী পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেন। তার পর বিলেত যান। বিলেত যাওয়ার আগে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে কাজ করেছিলেন। এর পরে তাঁর জীবনে নানা সাফল্য ও স্বীকৃতি আসে। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজমাতার চিকিৎসার্থে নেপালেও আমন্ত্রিত হন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছ'জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন কাদম্বিনী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। কাদম্বিনী কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তাও।
শুধু নিজের কর্মজগতেই তাঁর দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল না। কাদম্বিনী চা-বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়েও অবগত ছিলেন। চা-বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে তাঁর স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন তিনি। দ্বারকানাথ আসামের চা-বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন। কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে কাদম্বিনী ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিহার এবং ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন।
এক পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদ লেখেন, তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সকল বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার এই ক্ষমতা তাঁকে শুধু সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজেই নয়, সামগ্রিকক ভাবে বাঙালি সমাজেই এক বিশিষ্ট নারী হিসেবে তুলে ধরেছিল।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর কাদম্বিনী একটি অপারেশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। আজ, ডুডলের মাধ্যমে গুগলও সম্মান জানিয়েছে কাদম্বিনীকে।