মৃণাল সেন: একটা কমিটমেন্ট, স্ট্রেট লাইনে ভাবা

Fri, 14 May 2021-8:32 pm,

নিজস্ব প্রতিবেদন- 'একে আপনারা সিনেমা বলেন নাকি, এতো আমার আপনার জীবনের কথা'। মৃণাল সেনের জন্মবার্ষিকী আজ। ৯৯ তম। সত্যজিৎ ১০০র ঠিক ১২ দিন পরে ৯৯ হল মৃণালের। 

মৃণাল সেন মানেই একটা কমিটমেন্ট। স্ট্রেট লাইনে ভাবা। অনেকেই ভাবতে পারেন, 'বড্ড ডিরেক্ট'। কিন্তু তিনি ভাবতেন, 'আই মাস্ট মেক এ পয়েন্ট'। সময়ের উন্মত্ততাকে ধরেছেন তাঁর ক্যানভাসে। তাই দেখতে আজও টানে তাঁর কলকাতা ট্রিলজি, নকশাল আন্দোলন।

তাঁর কালজয়ী ছবি 'আকালের সন্ধানে', 'ভুবন সোম', 'রাত-ভোর', 'বাইশে শ্রাবণ'-এর জন্য তিনি অবিস্মরণীয়। তবে পরিচালক হিসাবে নয়, সাংবাদিকতা দিয়ে কাজের শুরু, পরবর্তীকালে মেডিক্যাল রিপ্রোজেন্টেটিভ হিসাবেও কাজ করেন। থিয়েটার মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ঠকই, কিন্তু সিনেমা করবেন, এমনটা দূর-দূরান্ত অবধি ভাবেন নি। ১৯৫৫ থেকে সিনেমায় পথচলা শুরু। একের পর এক কালজয়ী ছবি এল তারপরেই।

'মৃগয়া' ছবিতে মৃণাল সেন বেছে নেন মিঠুন চক্রবর্তীকে। মিঠুনের অবশ্য তখন নাম গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। সেইসময়ের মিঠুন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে। প্রথম ছবিতেই মিঠুন-মমতাশঙ্করের অভিনয় পর্দায় যেমন এক নতুন সমীকরণ তৈরি করে, ঠিক তেমনই মিঠুনের অসামান্য অভিনয় তাঁকে তাঁর প্রথম জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। 

পরিচালক মৃণাল সেনের খুব পছন্দের অভিনেতা ছিলেন অঞ্জন দত্ত ও মমতাশঙ্কর। তাঁদের উপর পরিচালকের ভরসা একাধিক ব্যতিক্রমী ছবি উপহার দিয়েছে ভারতীয় সিনেমাকে। অঞ্জন দত্ত অবশ্য এমনিতেও মৃণাল সেনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর অগ্রজ পরিচালককে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করছিলেন অঞ্জন। সেই কাজ সম্ভবত শেষ হয় নি। 

প্রায় ৫ দশক ধরে তিনি শুধুমাত্র বাংলা নয়, গোটা দেশের চলচ্চিত্র ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক সচেতনতার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। ব্রেখটের এপিক থিয়েটার এলিয়েনেশন এফেক্ট তত্ত্ব তাঁর শিল্পভাবনায় ছাপ ফেলেছিল। প্যারিসের নিউ ওয়েভ ফিল্ম মুভমেন্ট থেকে সাহস ও অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন তিনি। 

বিভক্ত স্বাধীন ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ জীবন ও অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ-আকাল-মৃত্যুর তুলনা ও দুই সময়ের পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ সালে রিলিজ করলেন 'আকালের সন্ধানে'। 'আকালের সন্ধানে' ছবিতে পরিচালক মৃণাল সেন ব্যবহার করেন অভিনেতা স্মিতা পাটিলকে। স্মিতা তখন বম্বে ফ্ল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকা। কিন্তু চরিত্রেটি তাঁর এতই পছন্দ হয় যে তিনি মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হন।  সাদা-কালো মনোক্রোমে এ ছবি আন্তর্জাতিক সিনেমাতেও অমূল্য।

শাবানা আজমির মৃণালদা। প্রথম যখন ছবি করতে আসেন বাংলায় মৃণাল সেনের পরিচালনায়, শাবানাও তখন বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁকে দেখেই মৃণাল বলেছিলেন, 'আর ভ্রু প্লাক করো না'। সেই কথা তাঁর মনে এত বেজেছিল যে, জীবনে আর কখনও ভ্রু প্লাক করেন নি, জানিয়েছেন শাবানা। বাবা কাইফি আজমির বন্ধু, পিপলস থিয়েটারে সতীর্থ, বাম মনোভাবাপন্ন দুই পরিবার, তাই আজীবন সম্পর্ক ছিল অটুট।  একইরকম সমাজ তৈরির স্বপ্ন দেখতেন যে!

১৯৮৩ সালে 'খারিজ' ছবির জন্য কান আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত হন।  একে একে তৈরি করেন 'মৃগয়া', 'কোরাস', ' অন্তরীণ','একদিন অচানক', 'মহাপৃথিবী', 'পরশুরাম'...এমন আরও ছবি।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত তাঁর নাম। তাঁর গুণমুগ্ধ পরিচালক শ্যাম বেনেগাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,'মৃণালদা কিন্তু কখনই দ্বিতীয় সত্যজিৎ ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর মত করেই অনন্য'।

আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী মৃণাল সেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কখনও পার্টির সদস্য হন নি। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসাবে মৃণাল সেন রাজ্যসভার সদস্য হন।

মৃণাল সেন এমনই একজন পরিচালক, যিনি বিশ্বাস করতেন, সিনেমা বিনোদনের জন্য নয়, ছবির মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। বাড়ির উঠোন থেকে ময়দান, গলি থেকে রাজপথ, শহরের বস্তি থেকে হাইরাইজ তাঁর সিনেমায় ম্যাজিক তৈরি করেছে। আর ভারতীয় ছবির এই ন্যারেটিভ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বের আঙিনায়। 

অনেকেই বলেন, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো এমন এক চোখ নিয়ে চলে গেছেন মৃণাল সেন, সংলাপের জাদুকর, ক্যামেরার লেন্সে দুনিয়াদারিতে এক নিপুণ পরিচালক।  ভাবনা বদলে দেওয়ার সেইসব মানুষেরই আজ বড় অভাব। তাই কি সিনেমার ফ্রেম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সাহস! 

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link