ছ`দশক ধরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের রহস্যমৃত্যু! নেপথ্যে কারা?
কেন হঠাৎ বিজ্ঞানীর রহস্যমৃত্যু নিয়ে ভাবনা? আসলে ক'দিন আগে এই ভাবনা উসকে দিয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী তপন মিশ্র। 'ইসরো'র দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তিনি একটি ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, বছরতিনেক আগে সেখানে তাঁর খাবারে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। কেন? তপনের বক্তব্য, 'সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার' নিয়ে তাঁর কাজের জন্যই তিনি এই হিংসার শিকার। বিজ্ঞানীদের ওপর এই রোষ-হিংসার অবশ্য় এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭০৭। ভিয়েনার পথে পাড়ি দিলেন ভারতের পরমাণু গবেষণার প্রাণপুরুষ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। সালটা ১৯৬৬। ভিয়েনায় পৌঁছনো হয়নি ভাবার। আল্পস পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ে বিমান। তথাকথিত 'বিমান দুর্ঘটনা'য় মৃত্যু হয় ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানের পথিকৃতের। কিন্তু সম্প্রতি হাতে আসা তথ্য বলছে অন্য কথা। সামনে এসেছে সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাস আর তৎকালীন CIA অফিসার রবার্ট টি ক্রাইলের কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপ্ট। তাতে স্পষ্ট, এর পেছনে হাত ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা CIA-র। কারণ, ষাটের দশকেই পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল ভারত। আর তার এই অগ্রগতির সঙ্গী ছিল মার্কিনি শত্রু-দেশ রাশিয়া। সিআইএ অফিসারের বয়ান ছিল, “.. the thing is, they were getting into bed with the Russians.’ এ কারণেই কি ভারতের পরমাণু শিরদাঁড়া ভাঙতে খুন করা হয়েছিল ভাবাকে? সফল প্রচেষ্টা। কারণ এক ধাক্কায় কয়েক দশক পিছিয়ে গিয়েছিল সমস্ত কিছু।
হোমি জাহাঙ্গির ভাবাকে যদি ভারতের পরমাণু গবেষণার পথিকৃত বলা হয়, তাহলে বিক্রম সারাভাই ভারতের মহাকাশ গবেষণার প্রাণপুরুষ। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর অস্বাভাবিক মৃত্যু সারাভাইয়েরও। কেরলের কোভালাম বিচে তাঁর প্রিয় রিসর্টেই দেহ উদ্ধার হয় তাঁর। কীভাবে মৃত্যু? জানা নেই, কারণ এখানেও পোস্ট মর্টেম হয়নি। এরও কোনও ঠিকঠাক তদন্তও সেই সময় হয়নি। বিক্রম সারাভাইয়ের সহকর্মী কমলা চৌধুরীর দাবি ছিল, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকেই নাকি সারাভাই তাঁকে বলছিলেন, আমেরিকা ও রাশিয়া তাঁর ওপর কড়া নজর রাখছে। কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ছিলেন বিজ্ঞানী। কিন্তু শেষ রক্ষা হল কই। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের, আচমকা মৃত্যু।
২০০৯ থেকে ২০১৩। ভারতের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১১ জনের নানা ভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। যাঁদের মৃত্যুরহস্যের আজও কিনারা হয়নি। অনেক মৃত্যুতেই লেগেছে আত্মহত্যার তকমা। কোথাও আবার দুর্ঘটনা। সম্প্রতি একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশের প্রথম পরমাণুশক্তি চালিত সাবমেরিন INS আরিহান্ত। তার চিফ ইঞ্জিনিয়ার অভীশ শিবমের দেহ মেলে রেললাইনে। ২০১৩-র অক্টোবরে। একই সঙ্গে উদ্ধার হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শিপ বিল্ডিং সেন্টারের আরেক ইঞ্জিনিয়ার কে কে জোশের দেহও। কেন মৃত্যু? কারণ আজও মেলেনি। এতটা অপদার্থ দেশের পুলিস, গোয়েন্দারা? মনিপাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিন মাধব নালাপতের বক্তব্য পরিষ্কার। ভারতের পারমাণবিক শক্তিবৃদ্ধির যাত্রাপথ ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করছে কোনও বিদেশি শক্তি। আর এই অপচেষ্টা শুরু থেকেই। আর মজার ব্যাপার, সরকার যেন চুপ করে আছে। দেখেও না দেখার ভান!
১৯৯৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ISRO-র কতজনের রহস্যমৃত্যু হয়েছে জানেন? ৬৮৪ জনের। ২০১০-এ RTI আন্দোলকারী চেতন কোঠারির দৌলতে এই তথ্য সামনে আসে। কাজের চাপে আত্মহত্যা জাতীয় কিছু বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে ISRO। তবে এটা সত্যি, চাপ রয়েছে। একটা জনবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বছরের পর বছর কাজ করে যাওয়া। অনেকটা প্রেসার কুকারের মতো দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। কিন্তু তাও, এত আত্মহত্যা? স্রেফ আত্মহত্যা?
নাম্বি নারায়ণন। ISRO-র প্রাক্তন বিজ্ঞানী। মিথ্যে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে জেল খাটতে হয় তাঁকে। সুপ্রিম কোর্ট বেকসুর খালাস করেছে তাঁকে। সম্প্রতি নারায়ণনকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মালদ্বীপের দুই স্পাইয়ের কাছে তিনি পাচার করেছেন ক্রায়োজনিক পদ্ধতির ফর্মুলা। অথচ ১৯৯৪ সালে যখন তাঁকে গ্রেফতার করা হল, তখন এই পদ্ধতি ঠিকমতো এদেশে শক্তপোক্তই হয়নি। বেকসুর খালাস পাওয়ার পর, ইসরোতেই ক্রায়োজনিক ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব সামলে গিয়েছেন তিনি। নারায়ণনের সঙ্গেই ডি শশীকুমারন নামে আরেক বিজ্ঞানীকেও একই ভাবে ফাঁসানো হয়। নারায়ণনকে ৫০ দিন জেলে কাটাতে হয়। নাম্বি নারায়ণনের অভিযোগ ছিল, জেলে তাঁকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। ইসরোরই আরেক বিজ্ঞানী, নারায়ণনের বস, এ ই মুত্থুনায়াগমকে এর সঙ্গে জড়াতে চাইছিল IB বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। তাঁকে দিয়েই মুত্থুনায়াগমের নাম নেওয়াতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ। এমনকি সেই সময় ইসরোও নারায়ণনের পাশে দাঁড়ায়নি। এক্ষেত্রে দোষ কাকে দেবেন? যাই হোক, নাম্বি নারায়ণনকে নিয়ে দক্ষিণে একটি ছবি রিলিজ হয়েছে গত মাসে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন নাম্বি নারায়ণনের মতো এত বড় বিজ্ঞানীকে এভাবে ফাঁসানো হল। অনুমান, সেই সময় সদ্য PSLV রকেট লঞ্চ করেছে ভারত। নারায়ণন সেই মিশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আরও উন্নততর ক্রায়োজনিক পদ্ধতির দিকে এগোচ্ছিলেন বিজ্ঞানী। হয়তো ভারতের দৌড় থামাতে নারায়ণনকে ধাক্কা দেওয়ার দরকার মনে করেছিল কোনও দেশ।