আইআইটি ইঞ্জিনিয়র থেকে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট `ভাইয়া` নভনীত

Soumitra Sen Sat, 19 Jun 2021-10:07 pm,

লক্ষ্মৌয়ে এক প্রোমোটারের কাছে ৫ লাখ তোলা চেয়েছিল এক দাগি অপরাধী। টাকাটা নিয়ে যেতে হবে নির্জন নীলমাথা এলাকার নির্মীয়মাণ এক বাড়িতে। সেই প্রোমোটারকে পাঁচ লাখের বদলে হাজার চল্লিশেক টাকা নিয়ে ওই বাড়িতে পৌঁছে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন এক উচ্চপদস্থ পুলিস অফিসার। ভয়ে ভয়ে গেছিলেন প্রোমোটার। তখন সন্ধে নেমেছে। বাড়ির বাইরের রাস্তা দিয়ে একটি কনেযাত্রীর দল যাচ্ছিল। ছিল পালকি, বাজনদার। বহু লোক হাঁটছিলও। হঠাত্‍ই ওই বাড়ির ভিতর থেকে গুলির আওয়াজ এল আর পালকি থেকে রিভলভার হাতে লাফিয়ে রাস্তায় নামলেন বর-কনে। ওই বরযাত্রীদলের সঙ্গে যাঁরা হাঁটছিলেন তাঁদের মধ্যেই ছিলেন উচ্চপদস্থ ওই পুলিস অফিসার। তিনিও অস্ত্র বাগিয়ে রেডি। সকলে অতর্কিতে বাড়ির ভিতরে আক্রমণ চালাল। শুরু হয়ে গেল দুষ্কতীর দলের সঙ্গে পুলিসের এনকাউন্টার। 

 

 ইমতিয়াজ নামের প্রোমোটারটি সেদিন একটুর জন্য রমেশ কালিয়ার গুলি থেকে বেঁচে গিয়েছিল। রমেশ কিন্তু বাঁচেনি। নভনীত সেকেরা নামের এক অসমসাহসী পুলিস অফিসারের পরিকল্পনার সঙ্গে এঁটে ওঠেনি। লক্ষ্মৌয়ে কুখ্যাততম অপরাধী রমেশ কালিয়ার এই এনকাউন্টার সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। 

এই চিত্রনাট্য যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত তিনি উত্তর প্রদেশের ইটা জেলার এক ছোট্ট গ্রামের এক অতি অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে। যাঁর বাবা মনমোহন সিং সেকেরা পেশায় এক সাধারণ চাষি। আর তাঁর মেধাবী ছেলেটির নাম নভনীত সেকেরা।

মেধাবী নভনীত ক্লাস টুয়েলভের পরে দিল্লির হংসরাজ কলেজে পড়তে গেলেন। বিএসসি-তে ভর্তি হবেন। ফর্ম নেওয়ার জন্য মার্কশিট বাড়িয়েছেন। কাউন্টারের ক্লার্ক চমকে উঠে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর নামধাম জিজ্ঞাসা করেন। তারপর ৫ টাকা তাঁর হাতে ধরিয়ে গ্রামে ফিরে যেতে বলেন। আসলে হিন্দি মিডিয়ামের গেঁয়ো ছেলের পক্ষে বিত্তবান বাড়ির ইংরেজিয়ানায় দুরস্ত ছেলেদের সঙ্গে পড়াটা কঠিন হবে ভেবে তিনি ছেলেটিকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটির মনে জ্বলে উঠেছিল আগুন।

এর পর নভনীত ঠিক করল সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন। কঠিন পরিশ্রমে ক্র্যাকও করলেন আইআইটি। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হলেন রুরকিতে। ১৯৯৩ সালে বিটেক করার পর এমটেক করার জন্য ভর্তি হলেন দিল্লি আইআইটিতে। 

 

দিল্লি আইআইটিতে থাকাকালীন একদিন সকালে বাবার ফোন এল। জমি দখলের মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, পুলিস চৌকিতে গিয়েছিলেন তিনি। পুলিস তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। ব্যস এ পর্যন্ত শুনে সমস্ত সংকল্প লক্ষ্য বদলে গেল নভনীতের। এমটেক ছেড়ে গ্রামে ফিরলেন তিনি। শুরু করলেন ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি। দারুণ রেজাল্ট করলেন। হলেন আইপিএস। এরপর গ্রামে ফিরে বাবাকে নিয়ে গেলেন সেই পুলিস চৌকিতে যেখানে একদা ঘাড় ধাক্কা জুটেছিল বাবার। সেদিন মনমোহনকে যাঁরা অপমান করেছিল তারাই নভনীতকে দেখে স্যালুট ঠুকতে বাধ্য হল। 

পুলিস অ্যাকাডেমির ট্রেনিং শেষে ১৯৯৮ সালে এএসপি হয়ে গোরখপুর। তারপর মেরঠ। ২০০১ সালেই এসপি। ২০০৩ সালে মুজফফর নগর। আতঙ্কের সন্ত্রাসের দুষ্কৃতীর আঁতুড়ঘর। সেখানে মাত্র ১৫ মাসে ৫৫ জন দাগি আসামিকে এনকাউন্টার করে খতম করেছিলেন। তারপরই লক্ষ্মৌ। এবং ওই রমেশ কালিয়া-পর্ব।

 

এ হেন নভনীত শুধু যে এই ধরনের অপরাধের বিহিতই করেন তা নয়। যে অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে নীরবে চলে আসছে সমাজে তা হল মেয়েদের উপর অত্যাচার। তার বিহিতও তিনি করেন। তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন WOMEN POEWR LINE 1090-র মতো এক পরিকল্পনার  কথা। সাফল্যও এসেছিল। মেয়েরা ধীরে ধীরে সাহস করে মুখ খুলছিল। আর নভনীতও পরের পর অ্যাকশন করে দমন করছিলেন অপরাধীদের। আস্তে আস্তে নভনীতের উপর ভরসা আসে মেয়েদের। তিনি বনে যান 'ভাইয়া'।

কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য নভনীত নানা সম্মান পেয়েছেন কর্মজীবন জুড়ে। তাঁর জীবন নিয়ে হয়েছে ওয়েব সিরিজ। কিন্তু নভনীতের জীবনে একটা উত্তরণ থেকে অন্য এক উত্তরণের দিকে যাওয়াটাই যেন স্বাভাবিক। তাই পুলিসের কাজ করতে করতেই এমবিএ করে নেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন উওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে নিত্য নতুন পরিকল্পনায় ও কর্মযজ্ঞে। 

 

২০২০ সালে এডিজি হয়েছিলেন নভনীত। মায়ের কাছে পদোন্নতির খবর দিতে এসে আবেগবিহ্বল নভনীত সেদিন বাবার জন্যও একরাশ দুঃখ অনুভব করেন। না, বাবাকে জানাতে পারেননি তাঁর এই পদোন্নতির কথা। বাবা যে ওই বছরেই কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। নভনীতের জীবনের সব চেয়ে প্রিয় মানুষ, প্রেরণার মানুষ, যাঁর একটা ফোন জীবনটাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বইয়ে দিয়েছিল নভনীতের। 

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link