Uttam Kumar: সারাজীবনে অজস্র হিটের পরেও কেন্দ্রবিন্দুতে `নায়ক`, ৫৫ বছর ধরে সেই ট্র্যাডিশন চলছেই
নিজস্ব প্রতিবেদন- রাত পোহালেই আরেক ২৪ জুলাই। উত্তম কুমারের প্রয়াণ বার্ষিকী। তাঁর অভিনয় জীবনে অজস্র হিট ছবি, তার থেকেও বেশি হিট গানে লিপ, প্রযোজক-পরিচালক হিসাবেও বেশ কিছু মনে রাখার মত ছবি করেছিলেন উত্তম কুমার। কিন্তু আজও বাঙালির মননে চর্চায় সত্যজিৎ রায়ের ছবির 'নায়ক' উত্তম।
কথায় বলে, পরিচালকই নায়ক তৈরি করেন। সত্যজিৎও তেমনটাই করেছিলেন। সবথেকে বড় উদাহরণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্রকে নিয়ে অনেকগুলি ছবিই তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। বরং সেই সময়ের সুপারস্টার উত্তম কুমারকে তাঁর ছবিতে তিনি ততটা ব্যবহার করেন নি। কিন্তু কেন? পরিচালক নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, উত্তমকে নতুন করে বানানোর কিছু ছিল না তাঁর। তবু সেই উত্তম কুমারকে নিয়েই তৈরি করেন ‘নায়ক’, ১৯৬৬ সালে।
ছবিটি মুক্তির ৫৫ বছর সদ্য পার হল। এই ছবিতে প্রতিষ্ঠিত একজন নায়ককে দিয়েই সত্যজিৎ প্রকাশ করেছেন একজন নায়ক, একজন তারকার অন্দরের-অন্তরের মানুষটিকে। স্টারডম কীভাবে একে একে পরিচিত জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক নতুন জগতে পৌঁছে দেয় সাধারণ একজনকে।
'অনেক রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার'......তারকার অনেক তাড়া থাকে। তাড়াতাড়ি নাম করতে হবে। প্রশংসা, হাততালি কুড়োতে হবে। অর্থ উপার্জন করতে হবে। তার জন্য নানা সিঁড়ি দরকার। যদিও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় সেই সব কাহিনি। সত্যজিৎ রায় ৫৫ বছর আগে উত্তম কুমারের মত একজন বড় তারকাকে নিয়ে ছবি বানিয়ে সেই ইঙ্গিতই দিয়ে গেছেন।
'নায়ক' ছবিতে সুপারস্টার নায়কের নাম অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন তিনি। এত বড় সুপারস্টার ট্রেনে যাচ্ছেন কেন? নায়কের জবানিতে বিমানের টিকিট পাননি বলেই ট্রেনে রওনা দিয়েছেন। রেলগাড়ির কামরায় তাঁর পরিচয় হয় অদিতি সেনগুপ্ত নামের এক সাংবাদিকের সঙ্গে। শিক্ষিত, রুচিশীল, মার্জিত অদিতি ‘আধুনিকা’ নামে মেয়েদের একটি পত্রিকার সম্পাদক। অদিতির কথায় বোঝা যায়, মূলধারার অরিন্দমের মত তারকাদের পাত্তা দেন না। তবে পত্রিকার পাবলিসিটির কথা ভেবে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার পেতে চান।
নায়কের প্রতি এক সাধারণ তরুণীর মুগ্ধতার পরিবর্তে অদিতি তাঁর অন্তরমহলের অনুভূতিগুলো জানতে চান। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই যে বেশি করে পাওয়া, এর মধ্যে একটা ফাঁক, একটা অভাববোধ, কোনো অনুতাপ নেই?’ নায়কও জবাব দেন, ‘আমাদের খুব বেশি কথা বলতে নেই। আমরা ছায়ার জগতে বিচরণ করি তো, কাজেই আমাদের রক্ত–মাংসের জ্যান্ত শরীরটা জনসাধারণের সামনে খুব বেশি করে তুলে না ধরাই ভালো।’
'আধুনিকা' পত্রিকার পাঠকদের জন্য না হলেও সুন্দরী, তীক্ষ্ণ সাংবাদিকের কাছে ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরেন 'নায়ক' অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। মনের আগল খুলে জানিয়ে দেন সফল নায়কের নানা অনুভূতি—জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়, নিঃসঙ্গতা, অপরাধবোধ, লোভ, বন্ধু বিচ্ছেদ, একাকীত্বের কথা। দর্শকও সবটাই দেখেন ফ্ল্যাশব্যাকে ।
প্রচলিত ধারণা এই যে, উত্তম কুমারের জীবনের ওপর ভিত্তি করেই 'নায়ক' ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় উঠে এসে বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন নায়ক হিসেবে। ছবিতে সুযোগ পাওয়ার আগে পাড়ায় অ্যামেচার থিয়েটার করতেন তিনি। অনেকটা সেই গল্পের সূত্র ধরেই যেন 'নায়ক' ছবির অরিন্দমের থিয়েটারের গুরু শঙ্কর দা উঠে আসেন স্বপ্নে। শঙ্করদার সাংলাপের মাধ্যমেই যেন পরিচালক সত্যজিৎ সেইসময়ের সিনেমা সম্পর্কে থিয়েটারের ধারণা প্রকাশ করেন। চোখা সংলাপে শঙ্করদা বলে ওঠেন, ‘ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি, কিন্তু তার সঙ্গে আর্টের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না।’
সত্যজিৎ রায় ও উত্তম কুমারের ভিতরের এই পারস্পরিক আস্থা বোধই বোধহয় আজও 'নায়ক' ছবিকে এত প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। বাঙালির সেরাতম আইকন হওয়ার জন্য উত্তম কুমারের অভিনয়কে বেশ কিছু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। অনেকেই তাঁর বিশেষ কথা বলার ধরণ, সিগারেট ধরানো, চুলের স্টাইল নিয়ে সমালোচনা করেছেন। যে চরিত্রেই তিনি পর্দায় আসুন না কেন, তিনি 'গুরু'। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে উত্তম কুমারের সেই ইমেজটাকেই ব্যবহার করেছেন।
‘নায়ক’-এর নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর ওরফে অদিতি সেনগুপ্তের মনে নায়কের ব্যাপারে যে নৈর্ব্যক্তিক ভাব শুরুতে ছিল, সেটাকে সহানুভূতিতে পৌঁছে দিয়েছেন পরিচালক। নায়ককে অবাক করে পুরো সাক্ষাৎকারটি ছিঁড়ে ফেলেন সাংবাদিক অদিতি। নায়ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘মন থেকে লিখবেন নাকি?’ নায়িকা বলেন, ‘মনে রেখে দেব।’ বুঝিয়ে দেন, বিনোদন পত্রিকার সাংবাদিক মানেই গসিপ কলাম নয়।
১৯৬৬ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড' পায় এই ছবি। ‘শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ কাহিনি ও চিত্রনাট্য’ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সম্মান দেওয়া হয় ‘নায়ক’ ছবিটিকে। অতি বড় উত্তম-বিমুখও বলেন, উত্তম কুমারের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় এই ছবিতেই। তাই আজও এতবছর পরেও উত্তমের জীবনের এপিটাফ যেন বাধা আছে 'নায়কে'ই।