রাহুলের `কাতরা কাতরা` জীবন, গুলজার, আশা, কিশোর, লতা, রফিময় সঙ্গীত

Sun, 27 Jun 2021-1:08 pm,

নিজস্ব প্রতিবেদন- আজ রাহুল দেব বর্মনের জন্মবার্ষিকী। তাঁর গানেই মুখরিত চারদিক। গান বাজছে রেডিও,টেলিভিশন, অনলাইনে। কিন্তু আজও গুলজার খুঁজে বেড়ান তাঁর প্রাণের বন্ধু আর সঙ্গীত সহচরকে। এ শূন্যতা আর পূরণ হবেনা কখনো।  এক সাক্ষাৎকারে গুলজার বলেছিলেন, আমাদের কাজের ধরণ ছিল একদম আলাদা। লং ড্রাইভে ড্রাইভিং হুইলে টোকা দিতে দিতে সুর করে ফেলতে পারতেন পঞ্চম। তাঁর কাছের মানুষরাও জানতেন, কাপ-পিরিচ অথবা বোতল বাজিয়ে সুর করার ক্ষমতা ছিল সহজাত।

যখনই পঞ্চমের মাথায় কোনও সুর আসত, গুলজাররের কাছে শব্দ চাইতেন। একজন সুরকার  একজন শিল্পীর গলায় সুরটি তুলিয়ে রাখলে সেটা মনে থাকার কথা। কিন্তু পঞ্চমের সবই যে উলটপুরাণ। শব্দে বসিয়ে রাখতেন সুর। একটা চেহারা পেয়ে যেত গানটি। পরে শব্দ মনে পড়লেই  সুরও ভেসে উঠত মনে।  বিমল রায়ের সেটে কোন এক ছবির গানের সুর করছিলেন বাবা শচীনদেব। তরুণ রাহুল তখন সৌনে টগবগ করছেন, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বারবার বাবাকে পরামর্শ দিচ্ছেন, এভাবে না হয়ে যদি ওভাবে, ওভাবে না হয়ে রিদমটা যদি এভাবে হয়। বিরক্ত শচীনকর্তা তাঁকে বাইরে যেতে বললেন, তারপর বলেন, ''গানের চরিত্রটাই ধরতে পারেনি ছেলেটা''। সেই পঞ্চমই তাঁর আজীবনের গানকে দিয়ে গেলেন এক অননুকরণীয় চরিত্র। কখনও রাগ সংগীতের বিস্তারে, কখনও আবার পশ্চিমী সঙ্গীতের ঝঙ্কারে। 

ভারতীয় সঙ্গীতে এই চতুর্ভুজ ভোলার নয়। সলিল চৌধুরীর মতে, 'সবসময়ের সৃজনশীল এবং নিরীক্ষাধর্মী রাহুল দেব বর্মন। সবসময়ের সেরা সঙ্গীত পরিচালক।’ বাবা শচীন দেব বর্মন বরাবরই সলিল চৌধুরীকে বলতেন, 'ও তোমার মত হয়েছে, ওকে একটু দেখো'। কালের বুকে এমন সময় বারবার আসে না, যখন দিকপাল ও শ্রেষ্ঠ প্রতিভারা একসময়ে জন্ম নেন। ভারতীয় সঙ্গীতের এই সময়টা এমনই। রাহুল দেব বর্মন, লতা, আশা, কিশোর- একই সময়ে  অনেক কাজ করেছএন একসঙ্গে। একসঙ্গে কাজ করার ফলে ভারতীয় সঙ্গীতকে একধাক্কায় এগিয়ে নিয়ে গেলেন অনেকটাই। আর রাহল তো বরাবরাই ব্যতিক্রম, তাঁর ভাবনায়, তাঁর প্রয়োগে।

শোলে’ ছবির সময়ে আর ডি বর্মন স্ত্রীকে বলেছিলেন, ”একটা দৃশ্য ভাবো তো! একজন মোটাসোটা জিপসি মহিলা বসে আছেন আগুনের ধারে। তিনি একটা গান গাইছেন। আর, তাঁকে ঘিরে নাচছে একজন তন্বী যুবতী।” আশা ভোঁসলে গানের সুর শুনেই বলেছিলেন, ”আমি এই গাইব না! আমার গলা বসে যাবে!” সেই গানই আর ডি নিজে গাইলেনৎ তৈরি হল ‘মেহবুবা, মেহবুবা’!

ছবি আরাধনা। সুরকার শচীন দেব বর্মন। ছবির কাজ শুরু হল, অসুস্থ হয়ে পড়লেন শচীন কর্তা। সহকারী রাহুল দেব বর্মন দায়িত্ব নিলেন অসমাপ্ত কাজের। সকলেই বলেন, পঞ্চমের হাত ধরেই এলেন কিশের কুমার আর 'এক্সিট' হল শচীন কর্তার প্রিয় মহম্মদ রফির। এরপর থেকেই রাজেশ খান্নার প্লেব্যাক ভয়েস হিসাবে এমন জনপ্রিয়তা পান কিশোর যে রফি সাহেবকে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে হয়। অথচ এই মহম্মদ রফি আর রাহুল দেব বর্মনের পুনর্মিলন এমন এক গানে হয়, যা হিন্দি ছবির গানে আজও 'কাল্ট'। 'ম্যায়নে পুছা চাঁদ সে কি দেখা হ্যায় কভি........'

জন্মদিনে স্মৃতি ভিড় করে আসছে অনুরাগীদের আর কাছের মানুষদের মনে। আশা যেমন জানিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, আর ডি চলে যাওয়ার পর তাঁর খুব আফসোস হয়। মনে হয়, ''যে গান গাইতে রাজি হই নি, সেটা গাইলেই হত! না হয় আরও কয়েকটা গান ছেড়ে দিতে হত! কিন্তু, মানুষটার ইচ্ছেটা পূর্ণ হত!'' রাহুল ছাড়া বেসিক বাংলা গান গাইতে চান না কিংবদন্তি শিল্পী। বলেম, ফিল্মের গান গেয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আধুনিক গানে পঞ্চম তাঁকে যে 'পকড়'টা দিতেন, তাতে অতি কঠিন গানও সহজ হয়ে যেত।

সেসময়ে ছবির গানের রেকর্ডিংয়ে অভিনেতারা আসতেন। তিনি যতবড় স্টারই হন না কেন। গান তৈরির প্রসেসটার মধ্যে জুড়ে থেকে সেই গানে লিপ দিতেন। আর ডি, কিশোর, রাজেশের আকাশছোঁয়া সাফল্যের ব্যাখ্যা বোধহয় এভাবেই করা যায়।

হিন্দি ছবির 'কাল্ট' সময় এটা। প্রচুর ম্যানারিজম নিয়ে অভিনয় করতে এলেন দেব আনন্দ। অথচ ভারতীয় ছবিতে চিরকালীন হয়ে গেলেন তাঁর ছবির গানের জন্য। আর তার শীর্ষভাগের কৃতিত্ব রাহুল দেব বর্মন আর কিশোর কুমার জুটির।

লতাদিদি যদি সেদিন 'ছোটে নবাব' ছবির গান গাইতে রাজি না হতেন, তাহলে পঞ্চমের সুরকার যাত্রা কি এত মসৃণ হত? এ প্রশ্ন উঠেছে বারবার। সেদিনের স্মৃতিচারণায় লতাজি বলেন, 'প্রাণচঞ্চল ছটফটে ছেলে, আলাদা কিছু করে দেখানোর স্বপ্ন দুচোখে, অথচ গানটি যখন শোনাতে এলেন, তখন তাঁর মাধুর্যে মুগ্ধ হই।' আর অনেকেই মানেন, আরডি-আশা যদি ম্যাজিক হয়, তবে আর ডি-লতায় আছে সমুদ্রের গভীরতা।

গুলজার একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আর ডি বর্মনের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজের অভিজ্ঞতার কথা। ছবির নাম ‘পরিচয়’। গান লিখছেন গুলজার, সুর দেবেন আর ডি। আর ডি হঠাৎ করেই গভীর রাতে আসেন গুলজারের বাড়িতে। বললেন, ”নিচে এসো, গাড়িতে ওঠো!” তার পর সারা রাত গাড়ি নিয়ে মুম্বই চষে বেড়ালেন আর ডি। আর গুলজারকে শুনিয়ে গেলেন একটার পর একটা ছবির জন্য বাঁধা গান! গুলজারের কথায়, ''এই পাগলামিকে অনেকেই বলবেন সৃষ্টিশীলতা! যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলবেন, এটাই আর ডি বর্মন''!

১৯৭২ সালে যখন প্রথম কাজ করছেন একসঙ্গে, ‘পরিচয়’ ছবিতে, তখনই মাঝরাতে গুলজারের বাড়িতে হাজির পঞ্চম। সুর হয়েছে। কোন সুর? ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ...’।  ভোররাতেই বেরিয়ে পড়লেন দুই বন্ধু।  সারা শহর ঘুরলেন, আর অনবরত পঞ্চম গেয়ে চললেন এই সুর। গুলজার  তাঁর পঞ্চম স্মৃতিতে লেখেন, এই ছিল পঞ্চমের অভ্যাস। একবার সুর হয়ে যাওয়ার পর তিনি বারবার সেটিকে গুনগুন করতেন। পঞ্চম জানতেন, সুর শুধু এসে যায় না, তাকে রচনা করতে হয়। ঠিক যেভাবে শিশুকে লালন-পালন করতে হয়। বড় করে তুলতে হয়, সুরকেও গাইতে গাইতে লালন করতেন পঞ্চম। 

গুলজারের মনে হয়, পাহাড়ি পথের বাঁকে, মেঘ আর উপত্যকার মাঝে ভেসে আসা সুরের ধারাই পঞ্চম। যাঁকে তিনি বারবার হারিয়ে খুঁজে খুঁজে ফেরেন।

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link