রামমোহনের ১৪ বছর কলকাতাবাস যেন এক চিরবিস্ময়!
১৭৭৪ (মতান্তরে ১৭৭২) সালের আজকের দিনে, ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন রামমোহন রায়। তিনি আমাদের নবজাগরণের উদগাতা। তাঁর মধ্যে দিয়েই আধুনিকতার আলো আঠারো শতকে প্রথম এসে পড়েছিল এ দেশে।
রামমোহনের বিপুল জীবন। বিপুল তাঁর কর্মভার, অর্জন, কৃতি। কিন্তু মোটামুটি দেখতে গেলে তাঁর কলকাতা-বাস থেকেই জীবনের সব ক্ষেত্রে বৃহত্তর একটা বৃত্তে পৌঁছে যাওয়ার শুরু। ১৮১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি কলকাতায় আসতে থাকেন। তবে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন ১৮১৬ সাল থেকে।
কলকাতায় রামমোহনকে ঘিরে একটা বিদ্বজ্জনের পরিমণ্ডল গড়ে উঠল। কিন্তু শুধু দেশীয় বিখ্যাত মানুষজনই নন, রামমোহনের সঙ্গে তাঁর কলকাতার বাড়িতে এসে দেখা করেছেন বিখ্যাত পরিব্রাজক আর্ল অফ মানস্টার, ফরাসি বিজ্ঞানী ভিক্তর জ্যাকমঁ, ইংরেজ মহিলা ফ্যানি পার্কস।
রামমোহনের প্রথম-পর্বের জীবনে তাঁর বিশিষ্ট ধর্মচিন্তার তেমন চিহ্ন দেখা যায়নি। তবে ভাবনার দিক থেকে তিনি একেশ্বরবাদীই ছিলেন। কিন্তু কলকাতাবাস-পর্বেই তিনি ভাবলেন ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন আছে। এরই ফলশ্রুতি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা। তবে তার আগে তিনি আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে আগতদের মধ্যে একটু মতভেদ তৈরি হতে রামমোহন ব্রাহ্ম সমাজ গড়লেন। সেটা ১৮২৮ সালের ২০ অগস্ট। তিনি তাঁর ব্রাহ্ম ধর্মের ভাবনা রচনা করেন। সব চেয়ে আশ্চর্যের, এই সময়ে তাঁর ভেতর থেকে কবি-মানুষটি বেরিয়ে আসেন। তিনি রচনা করেন কতগুলি ব্রহ্মসঙ্গীতও।
তবে যে কারণে রামমোহনকে উত্তরকাল সব চেয়ে বেশি মনে রেখেছে তা হল তাঁর সতীদাহ প্রথা রদ। ১৮২৯ সালে তাঁর চেষ্টায় এই বর্বর প্রথা বন্ধ করতে সক্ষম হয় ব্রিটিশেরার
তবে তাঁর আরও এক দারুণ কর্মপ্রতিভা বাঙালিকে এগিয়ে দিয়েছে। তা হল তাঁর বাংলা ভাষা চর্চা। তিনিই বাংলা ব্য়করণ রচনা করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বহু জরুরি লেখাপত্র বাংলায় লেখেন। বাংলা ভাষাটা তাঁর হাতেই সেই সময়ে মর্যাদা পেতে শুরু করে।
এই দারুণ প্রতিভাবান মানুষটি কলকাতা থেকে পাশ্চাত্যে রওনা দেন ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর। প্রায় ১৪ বছরের কর্মমুখর উর্বর এক কলকাতা-জীবন কাটিয়ে রামমোহন ইংলন্ড যাত্রা করলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি কালাপানি, মানে সমুদ্র পেরোলেন।
ইংলন্ডে গিয়েও তিনি প্রবল ভাবে সমাদৃত হন। সেখানে বিখ্য়াত দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। রামমোহন প্য়ারিসেও যান। তার আগে তিনি ইংলন্ডেই রাজসম্মান অর্জন করেন।
নানা কিসিমের কাজকর্ম করতে গিয়ে হয়তো ভেতরে ভেতরে তিনি ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলেন। প্য়ারিস থেকে ব্রিস্টলে ফিরে তিনি জ্বরে পড়েন। আটদিন জ্বর ভোগ করে অবশেষে ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে প্রয়াত হলেন ভারতের এই কৃতী সন্তান।