Sarat Chandra Chattopadhyay: `উত্তরাধিকারসূত্রে` পেয়েছিলেন শুধু অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ
ফিরে ফিরে আসে সেপ্টেম্বর তথা ভাদ্র মাস। আর ৩১ ভাদ্রের জাতক কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি-কাতরতায় মাতে বাঙালি। ১৮৭৬ সালে হুগলির দেবানন্দপুর গ্রামে জন্ম।
তবে সারা জীবনই নানা স্থানে নানা দেশে নানা ভাবে জীবন কেটেছে শরৎচন্দ্রের। বিপুল তাঁর অভিজ্ঞতা। আর তাঁর নিজের দাবি, অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু লেখেননি তিনি। সেই হিসেবে শরৎচন্দ্রই প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় ঔপন্যাসিক যিনি যথার্থ অর্থেই আত্মজৈবনিক শিল্পী।
শরৎচন্দ্রের গোটা জীবনকে মোটামুটি চার পর্বে ভাগ করা যায়— দেবানন্দপুর-ভাগলপুর পর্ব, রেঙ্গুন-পর্ব, হাওড়া-শিবপুর পর্ব, আর সামতাবেড়-কলকাতা-পর্ব। এই জীবনযাপন-পর্বের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই বদলেছে তাঁর সাহিত্যসাধনা।
তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার স্ফুরণ ভাগলপুরে, ছোট সাহিত্যগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। এর পর রেঙ্গুনবাস-পর্বে 'বড়দিদি'র প্রকাশ। প্রকাশের পরেই খ্যাতিলাভ। এর পরে ঘটনাচক্রে দেশে ফেরা। আর ফিরে শেষমেশ সাহিত্যসাধনাকেই অবলম্বন এবং সেই সূত্রে খ্যাতির শিখরে আরোহণ।
কিন্তু কী ভাবে সাহিত্যভাবনা ঢুকল মাথায়? তাঁর সাহিত্যপ্রেম নিয়ে 'বাল্যস্মৃতি'তে দু'টি ঘটনা পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্র লিখছেন, ''এই সময় বাবার দেরাজ থেকে বের করলাম 'হরিদাসের গুপ্তকথা' আর বেরুলো 'ভবানী পাঠক'। গুরুজনদের দোষ দিতে পারিনে। স্কুলের পাঠ্য তো নয়, ওগুলো বদ-ছেলের পাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই নিতে হলো আমাকে বাড়ীর গোয়ালঘরে।'' আর এক জায়গায় লিখছেন, ''পিতার নিকট হইতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি।... কিন্তু এখনো মনে আছে ছোটবেলায় তাঁর অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কেন তিনি এইগুলি শেষ করে যাননি—এই বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কি হতে পারে ভাবতে-ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে।''
জীবনের প্রথম পর্ব নানা টালমাটালে কেটেছে। দারিদ্র্য, পড়াশোনা বন্ধ হওয়া-- নানা বিপর্যয়। লেখালিখি ওরই মধ্যে চালিয়ে গিয়েছেন। তবে সেরকম ভাবে নয়। একটু আড়াল থেকে। ১৮-১৯ বছর বয়সেই লেখা প্রথম প্রকাশিত। সুখ্যাতিও লাভ।
১৯০৩ সালে ২৭ বছরের যুবক শরৎচন্দ্র জাহাজে চেপে অবশেষে বর্মায় হাজির হলেন। সেখানে তাঁর এক মাসিমা থাকতেন। তাঁরা বেশ বড়লোক। একরকম তাঁদের ঘরের ছেলে হয়েই তিনি সেখানে থাকতে শুরু করে দিলেন। এই সময়েই তাঁর জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে তিনি বর্মী ভাষাটাও শিখে নেন। কিন্তু অকস্মাৎ তাঁর মেশোমশাই প্রয়াত হওয়ায় তাঁদের রেঙ্গুনের পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে আসতে হল। আবার দুঃসময় শুরু হয় শরতের!
বাংলায় ফিরে আবার তাঁর ভিতর থেকে সাহিত্যের পোকাটা সাড়া দিল। তাঁর অনুরাগী-বন্ধুজনের অনুরোধ তো ছিলই। অবশেষে প্রথম প্রকাশিত লেখার প্রায় ১৮ বছর পরে, ১৯১৩ সালে আবার বাংলা সাহিত্যেক্ষেত্রে ফেরা।
আর তারপর তো বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকের ইতিহাস নতুন করে লেখার উপক্রম হল। উঁচুদরের চাকুরে বঙ্কিমচন্দ্র ও জমিদার রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে চাকরি বা বংশগৌরবের কৌলীন্যহীন শরৎচন্দ্রই সম্ভবত বাংলাসাহিত্যের প্রথম ব্যক্তি যিনি শুধু সাহিত্যরচনা করেই জোরের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দিনযাপন করতে পেরেছেন।