Shankha Ghosh: স্মরণীয় সমাপতন! বাণীবন্দনার তিথিই এবার কবিরও জন্মদিন
আজ, ক্যালেন্ডার বলছে ৫ ফেব্রুয়ারি। পাঁজি বলছে, আজ বসন্ত পঞ্চমী, সরস্বতী পুজো; পাশাপাশি আজ আরও এক বিশেষ দিন-- কবি শঙ্খ ঘোষের জন্মদিন আজ। ১৯৩২ সালের এই দিনেই জন্ম এই বাণী-কুমারের।
কবি মানে তো শব্দশিল্পী। শব্দ নিয়ে, বাণী নিয়ে তাঁর জগৎ। শঙ্খ ঘোষও তাঁর কবি-যাপনে সারা জীবন ধরে নানা শব্দ রূপক উপমা তির্যকতা নিয়ে নিবিষ্ট চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। ফলে সরস্বতীপুজোর দিনে, বাণীবন্দনার এই উদযাপন-লগ্নে কোনও বাণীর বরপুত্রের জন্মদিন পড়াটা রীতিমতো সুখকর সমাপতন বইকি!
বাঙালি কবিদের কোনও কোনও গোষ্ঠী বহুদিন ধরে বলে আসছে শঙ্খ ঘোষ একটু 'ওভাররেটেড' কবি; তবু এ কথা অস্বীকার করলে ইতিহাসের সত্যকেই উড়িয়ে দেওয়া হবে যে, জীবনানন্দ দাশ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৫৩ সালে প্রথম কবিতাপ্রকাশ, ১৯৫৬ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ; তার পর থেকে সুদীর্ঘ উচ্চাবচ বন্ধুর এক পথরেখা পেরিয়ে তিনি মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সৃষ্টিশীল ছিলেন! আলস্যসাধনের এই যুগে এ কি কম বড় কথা?
অধ্যাপনার পাশাপাশি কবিতার প্রতি তাঁর যে নিবিড় আত্মসমর্পণ তা বাংলা কবিতাকে কী অলৌকিক ভাবেই না মহিমান্বিত করল এতগুলি বছর ধরে। আজ চারিদিকে এই প্রহরজোড়া ত্রিতালের ঘোরতর কোলাহলের মধ্যে অনায়াসেই কি আমাদের মন বিড়বিড় করে বলে ওঠে না 'মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়' গ্রন্থের 'আয়ু' কবিতার সেই অমর পঙক্তি-- 'এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর'?
কিংবা সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আমাদের ঐকান্তিক আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা কি বিনা চেষ্টাতেই বলে উঠি না 'বাবরের প্রার্থনা'র সেই 'এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/আজ বসন্তের শূন্য হাত--/ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। যে-পঙক্তি 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'র মতো কালজয়ী এক পঙক্তির একটা যেন পোয়েটিক এক্সটেনশন হয়ে দাঁড়ায়!
সব সময়ে সৃষ্টির দিকে দরজা খুলে রেখেছিলেন তিনি। রেখেছিলেন বলেই তাঁর সেই অন্তর্দৃষ্টি ভরা, নিজের মনের ভিতরে চোখ ফেলা, আত্মনির্জনতার অমেয় ঢেউয়ে ভেসে পড়ার আশ্চর্য সব চিহ্ন বহন করেছে আমাদের বাংলা কবিতার জগৎ, আমাদের অনুভূতির পৃথিবীও। সৃষ্টির দিকে সদাই মুখ করে বসে না থাকলে কোনও কবির হাত থেকে কি বেরোয় 'শবের উপর শামিয়ানা' গ্রন্থের 'অবলীন' কবিতার এই পঙক্তি-- 'যে দূর দূরের নয়, যে দূর কাছের থেকে দূর/যে আকাশ ভরে আছে আকাশের ভিতরে বিধুর/যে স্বর স্বরের চেয়ে শরীরের আরো কাছাকাছি/আমার ভিতরে আমি ক্ষীণ তার প্রান্ত ছুঁয়ে আছি।'
প্রান্ত ছুঁয়ে থাকার অমোঘ কত চিহ্ন রয়ে গিয়েছে শঙ্খের এরকম সব উচ্চারণে-- 'জলপাতালের চিহ্ন চরের উপরে মুখে ভাসে/ তাঁবু হয়ে নেমে আসে সূর্যপ্রতিভার রেখাগুলি/ স্তব্ধ প্রসারিত-মূল এ আমার আলস্যপুরাণ।'